গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থ্যানের মধ্যদিয়ে হাসিনা সরকারের পতন হয়। মিছিল, সংঘর্ষ, পুলিশের গুলি, ছাত্রলীগ-যুবলীগের অস্ত্রের ঝনঝনানি ও লাশের সারিতে বিভীষিকাময় ছিলো সিলেট।
১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে সিলেট জেলায় মারা গেছেন ১০ জন। এর মধ্যে মহানগরে ৩ ও জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ৭ জন।
আর আহত হন দুই হাজারের অধিক। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ৩০০ জন। তাদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ছিলেন ১০-১৫ জন। রবিবার (১৮ আগস্ট) পর্যন্ত সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ৩৭ জন। একজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে।
জানা যায়, আহতদের অধিকাংশই গত ৪ ও ৫ আগস্টের আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এই দু’দিন কোথাও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ ও বিজয় মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ।
ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, গুলিতে গুরুতর আহত কারও শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে, কারও ফেটে গেছে মাথার খুলি। আবার কারও বিকল হয়ে গেছে কিডনি-চোখ। আহতদের শরীরে নতুন করে একটার পর একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। স্বজনদের ঘুম নেই। তাদের চোখে-মুখে বোবা কান্না। আহতদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বজন।
আরেক তরুণ গোয়াইনঘাটের দক্ষিণ পান্তুমাইয়ের ইদ্রিছ আলী। পেশায় অটোরিকশার চালক ইদ্রিছকে ওয়ার্ড থেকে ২৪ নম্বর কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। সরকার পতনের দিন উপজেলার সোনারহাট বিওপি-বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষকালে গুলিবিদ্ধ হন। গুলিতে তাঁর কিডনি বিকল হয়ে গেছে। বাবা আসমত আলীকে সন্তানের পাশে বসে হা-হুতাশ করতে দেখা যায়। একই কেবিনে আরেক তরুণ গোলাপগঞ্জের কানিশাইল গ্রামের হৃদয় আহমদ। তিনি একজন ফুটবলার। সরকার পতনের আগের দিন ঢাকা দক্ষিণে সংঘর্ষকালে তাঁর পেটের একপাশে গুলি লাগে।
হাসপাতালের ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি রুবেল আহমদ। তিনি পেশায় রাজমিস্ত্রি, বাড়ি বিয়ানীবাজারের মোল্লাপুরে। সরকার পতনের দিন থানায় আক্রমণকালে শত শত লোকের সঙ্গে তিনিও ছিলেন। শরীরে পেছন থেকে গুলি লেগে সামনে দিয়ে বের হয়ে যায়। একই ওয়ার্ডে ভর্তি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার তকবাজখালী গ্রামের ইসমাইল মিয়ার ছেলে তকবির মিয়া। বিএনপি সমর্থক তকবির মিয়া কথা বলতে পারছিলেন না। প্রস্রাবের রাস্তায় নল লাগানো, পেটে ব্যান্ডেজ করা। আনন্দ মিছিল করার সময় গুলি লাগে তাঁর পেটে।
রঙের কর্মী গোলাপগঞ্জ উপজেলার খাওগাঁওয়ের আবদুল মতিনের ছেলে রুমান আহমদ ৪ আগস্ট থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন। ওই দিন ঢাকা দক্ষিণ ও থানা সদরে দফায় দফায় সংঘর্ষে প্রাণ হারান সাতজন। রুমানের বুকে ও হাতে একসঙ্গে গুলি লাগে। একটি গুলি বুকের একপাশ ভেদ করে হাত ছিদ্র হয়ে বেরিয়ে যায়।
ওসমানীতে ভর্তি আছেন সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের মহব্বতপুর গ্রামের তরুণ নোমান আহমদ। বাসের হেলপার নোমান সরকার পতনের আগের দিন গোলাপগঞ্জ থানার সামনে কোমরে গুলিবিদ্ধ হন। বানিয়াচংয়ের চানপাড়ার সুমন মিয়ার গুলি লাগে ঊরু ও কোমরে। সিলেটে তিনি গাড়ি চালাতেন। সরকার পতনের দিন নগরীর ক্বিন ব্রিজ এলাকায় প্রায় শখানেক ছররা গুলি তাঁর পেটে ঢুকে যায়।
জানা গেল, ওসমানীতে আইসিইউতে থাকা মাথায় গুলিবিদ্ধ স্কুলছাত্র রাইয়ান আহমদকে গত শনিবার ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সে দক্ষিণ সুরমার সিলাম পিএল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। সিটিস্ক্যানে দেখা গেছে তার মাথার খুলি ফেটে গেছে। রায়হান আহমদ নামের আরেকজনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
ওসমানী হাসপাতাল ছাড়াও একাধিক বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে গুলিবিদ্ধ ১৫-২০ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে সিলেট জেলা ছাত্রদলের সাবেকসহ সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম টিপু রয়েছেন। যার একটি চোখ নষ্ট হতে চলেছে।
আহতদের স্বজনরা জানান- সরকারি ঘোষণার পর থেকে ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী বলেন, তিনজন অধ্যাপকের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আন্দোলনে আহত ২৩৭ জন ভর্তি হয়েছিলেন। গত রোববার পর্যন্ত ৩৭ জন চিকিৎসাধীন। আহতদের সব খরচ বহন করছে সরকার। এ ক্ষেত্রে সমাজসেবা অধিদপ্তর সহায়তা দিচ্ছে।