
ফজল উদ্দিন, ছাতক প্রতিনিধিঃ সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় অবহেলিত মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের দীর্ঘ ৫৪ বছরের বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় রচনা করলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তরিকুল ইসলাম। তাঁর মানবিক ও দূরদর্শী নেতৃত্বে গোবিন্দগঞ্জ পয়েন্টে সংলগ্ন একটি আধুনিক ও সুসংগঠিত মাছ বাজার স্থাপিত হতে যাচ্ছে, যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে শতাধিক মৎস্যজীবী পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। এই উদ্যোগকে স্থানীয়রা দেখছেন দশকের পর দশক ধরে চলমান একটি সমস্যার যুগান্তকারী সমাধান হিসেবে। হাওর-নদী-বিল অধ্যুষিত ছাতক উপজেলায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হাজারো মানুষ মৎস্য শিকারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তবে স্বাধীনতার পর থেকে তাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ও স্বাস্থ্যসম্মত বাজার ব্যবস্থার অভাব ছিল প্রকট। ফলে একদিকে যেমন তারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন, অন্যদিকে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছিলেন। এই দীর্ঘদিনের অবহেলার অবসান ঘটাতে কার্যকর ও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ইউএনও মো. তরিকুল ইসলাম। গত সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) গোবিন্দগঞ্জে এই আধুনিক মাছ বাজারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি। এসময় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, মৎস্যজীবী প্রতিনিধি এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
আনন্দঘন ও আবেগঘন পরিবেশে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে ইউএনও তরিকুল ইসলাম বলেন, “মৎস্যজীবীরা আমাদের দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। উপজেলা প্রশাসন তাদের পুনর্বাসনে এবং সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করবে। এই বাজারটি শুধু একটি অবকাঠামো নয়, এটি মৎস্যজীবী ভাইদের অধিকার ও সম্মানের প্রতীক।” তাঁর এই বক্তব্য উপস্থিত মৎস্যজীবী ও সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে এবং করতালির মাধ্যমে সকলে তাকে অভিনন্দন জানান।
স্থানীয়রা মনে করছেন, এই নতুন বাজার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মৎস্যজীবীরা সরাসরি ভোক্তার কাছে ন্যায্যমূল্যে মাছ বিক্রি করতে পারবেন। এর ফলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বহুলাংশে হ্রাস পাবে এবং জেলে পরিবারগুলোর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। শুধু তাই নয়, আধুনিক এই বাজারটি গোবিন্দগঞ্জ এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নতুন কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে, যা এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
গোবিন্দগঞ্জ ক্ষুদ্র মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, “আমরা যুগ যুগ ধরে একটি স্থায়ী বাজারের জন্য বিভিন্ন মহলে আবেদন করেছি, কিন্তু কেউ আমাদের দিকে ফিরে তাকায়নি। আজকের ইউএনও স্যার আমাদের দুঃখ বুঝেছেন। তিনি শুধু একজন ইউএনও নন, তিনি আমাদের মতো গরিব মানুষের অভিভাবক। আমরা তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মিয়া বলেন, “আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। এই বাজার আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ বদলে দেবে। আমরা ইউএনও তরিকুল ইসলামের এই মহৎ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই এবং তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক উপজেলা আমীর মাওলানা জালাল উদ্দিন এলাকার শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থেকে ছাতকে যোগদানের পর থেকেই ইউএনও মো. তরিকুল ইসলাম একের পর এক মানবিক, সামাজিক ও উন্নয়নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছেন। সীমান্তে ‘পুশ-ইন’ হওয়া পরিবারদের মানবিক সহায়তা প্রদান থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার রোধে জনসচেতনতা তৈরির মতো কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি অল্প দিনেই ছাতকবাসীর আস্থা অর্জন করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং সরকারি রাজস্ব আদায়েও তিনি স্থাপন করেছেন নতুন মানদণ্ড। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত মোবাইল কোর্ট পুরো উপজেলায় সাড়া ফেলেছে। মাদক, ইজারা বহির্ভূত বালু উত্তোলন, পরিবেশ দূষণ, ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন এবং সড়ক পরিবহন আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে তিনি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছেন। তাঁর কঠোর পদক্ষেপে ইতোমধ্যে অবৈধ বালু উত্তোলনকারী সিন্ডিকেট এবং মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ জব্দ করার পাশাপাশি সরকারি কোষাগারে রাজস্ব আয়ও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁর এ সকল কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করলেও অসাধু চক্রের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন তিনি। তবে সকল ভয়ভীতি ও চাপের ঊর্ধ্বে থেকে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন, যা তাকে সাধারণ মানুষের কাছে একজন ‘মানবিক ইউএনও’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মৎস্যজীবীদের জন্য এই বাজার স্থাপন তাঁর জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের মুকুটে আরেকটি উজ্জ্বল পালক যোগ করলো।