বিশেষ প্রতিবেদনঃ যারা দিনে বিএনপি আর রাতে আওয়ামী লীগ হয়ে মন্ত্রীর সিন্ডিকেটের সাথে চালাতেন ব্যবসা বাণিজ্য। মামলা-হামলার শিকার ছিলেন স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের ত্যাগী নেতাকর্মীরা।
বিগত সরকারের শাসন আমলে সীমান্ত জুড়ে সকল বে-আইনী বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, বালু-পাথর লুটপাট, চোরাকারবার নিয়ন্ত্রণ করতো স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগ আর দলীয় পরিচয় না দিয়ে নিজেদের মন্ত্রীর কাছের লোক পরিচয় দিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের কতিপয় কিছু নেতা।
মন্ত্রীর লোক হিসাবে পরিচিত শাহ আলম স্বপনতো নিজ দলের সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে উপজেলা নির্বাচন করে নির্বাচিত ও হয়েছিলেন সাবেক মন্ত্রী ইমরান আহমদের আর্শিবাদে। উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর মন্ত্রী লোক হিসাবে পরিচিত চাঁদাবাজ চক্রের সাথে গোপন চুক্তি করেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন ও তার পিএস যুবদল নেতা হেলোয়ার। অপর দিকে সীমান্ত এলাকার একাংশের নিয়ন্ত্রণকারী সরকারদলীয় নেতাদের সাথে আরেক গোপন চুক্তি করেন বর্তমান জেলা বিএনপির নেতা উপজেলা ৯নং ডৌবাড়ী ইউপি বরখাস্ত হওয়া চেয়ারম্যান আরিফ ইকবাল ওরফে নেহাল। বিগত সরকারে আমলে এরা সামনের সারিতে না থেকে সব সময় থেকেছেন মন্ত্রী সিন্ডিকেটের পিছনে পিছনে। সকল ব্যবসা বানিজ্যে ছিলেন সমান অংশিদার।
দীর্ঘ ১৫ বছর ঘাপটি মেরে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ইমরান আহমদের সাথে থাকা ব্যক্তিরাও এখন বিএনপি জামায়াতের ত্যাগী নেতা দাবী করতে শুরু করেছে। বিএনপি থেকে বহিস্কৃত সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপনের প্রত্যক্ষ মদদে এখন প্রকাশ্য জাফলংয়ে চলছে লুটপাট, চাঁদাবাজী, আর চোরাচালানের রাজত্ব্য। নিজের পিএস হেলোয়ারকে বানিয়েছেন এসব কর্মকান্ডের গডফাদার। সাবেক মন্ত্রী ইমরানের সাথে সখ্যতা থাকায় হয়ে ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান। বাধ্য হয়ে বিএনপি তাকে দল থেকে বহিস্কার করলেও তার ছিলোনা কোন আক্ষেপ। কারণ দিনে-দিনে উপজেলা চেয়ারম্যান স্বপন আর তার অনুসারীরা হয়ে উঠেছিলেন সাবেক মন্ত্রী ইমরানের কাছের লোক।
আরও পড়ুন–http://গোয়াইনঘাটের সীমান্ত চোরাচালান নিয়ন্ত্রনে আরিফ ইকবাল নেহাল
গত ৫ আগস্ট বিকাল থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকেই এক কোটি ঘনফুট পাথর লুট করা হয়েছে। তামাবিল স্থলবন্দর সংলগ্ন কাস্টমস গুদাম ও কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকাতেও ব্যাপক লুটপাট হয়। অথচ বিগত সরকারের শাসন আমলে এরা ছিলো সাবেক মন্ত্রী ইমরানের খাসলোক ও ঘনিষ্টজন হিসাবে অতিপরিচিত। নিপিড়নের শিকার ব্যক্তিরা থানায় মামলা করতে গেলে বিএনপির কয়েকজন চিহ্নিত নেতা চাপে মামলা নেননি সাবেক ওসি হারুন অর রশিদ। কেউ মামলা করতে গেলে বাদীদের চাপ দেওয়া হতো মামলা থেকে জাফলং এলাকার সাবেক মন্ত্রীর খাসলোক হিসাবে পরিচিত চাঁদাবাজদের নাম বাদ দিয়ে মামলা দেওয়ার জন্য।
গত শুক্রবার ১৫ নভেম্বর সরেজমিন জাফলং এলাকা ঘুরে জানা গেলো বিগত ৫ আগষ্ট থেকে এখন পর্যন্ত জাফলং পাথর কোয়ারীতে লুটপাট চালাচ্ছে স্বপন বাহীনির লোকজন। ইউসুব ও হেলোয়ারে নেতৃত্বে রাতের আধারে সুরক্ষা বাঁধ কেটে পাথর উত্তোলন করছেন কতিত এসব যুবদলের সুবিধাভোগীরা। যদিও দিনের বেলা ভাম্যমান আদালতের অভিযান চলে আর রাতে চলে ব্যাপক লুটপাট।
স্থানীয় একাধিক জনের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট রাত থেকে সীমান্ত চোরাচালানের শীর্ষ লাইনম্যান ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ হযরত, ইবু, মান্নান মেম্বারকে শেল্টার দিয়ে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান স্বপনের পিএস মিজানুর রহমান হেলোয়ার ও ইউসুফ আহমেদ ও আজির উদ্দিন জাফলং খাবলে খাচ্ছে। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপি থেকে বহিস্কৃত শাহ্ আলম স্বপনকে ম্যানেজ করে উপজেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আহমেদ, পূর্বজাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজির উদ্দিন রাতে জাফলং পাথর কোয়ারী ও চোরাচালানে ব্যাপক চাঁদাবাজী করে যাচ্ছেন। চাঁদাবাজী করতে গিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও জনতার হাতে আটক হয়ে ছিলেন এই দুইজন। সেসময় পরিস্থিতি বেগতিক দেখে যুবদল নেতা ইউসুফ সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের পিএস হেলোয়ারের পক্ষে ক্ষমা চেয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিজের চাঁদাবাজদের রক্ষা করেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ্ আলম স্বপন। স্থানীয়রা জানান, ইউসুফ ও আজির এবং হযরত, ইবু মিলে চাঁদাবাজিসহ চোরাচালান এবং লুটপাট থেকে আদায়কৃত অর্থ প্রথমে যায় মিজানুর রহমান হেলোয়ারের কাছে। মিজানুর রহমান হেলোয়ার তার গুন্ডা বাহিনীর মাঝে নিজেই চাঁদাবাজির টাকা বন্টন করেন। সম্প্রতি জাফলং জিরো পয়েন্টে চোরাচালানের লাইনম্যান হযরতের সাথে অবৈধ টাকার হিসাব নিতে গিয়ে সাংবাদিকদের গোপন ক্যামেরায় ধরা পড়েন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের পিএস যুবদল নেতা মিজানুর রহমান হেলোয়ার ও উপজেলা যুবদলের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আহমেদ।
কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে সব রকম অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাদের হাতে। সীমান্ত চোরাচালান, জাফলংয়ের চাঁদাবাজ চক্র গা ঢাকা দিলে এসব অপরাধীদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যায় স্থানীয় বিএনপি-যুবদলের কতিপয় কিছু নেতা।
পুলিশ-বিজিবি লাইনম্যানদের চাঁদাবাজিসহ সকল অপকর্মের নেতৃত্বে তিন ভাগে ভাগ করে নেন দিনে বিএনপি আর রাতে আওয়ামী লীগ করা বিএনপি ও যুবদলের নেতারা। নেহাল, স্বপনের নেতৃত্বে সীমান্ত জুড়ে এখনো চলছে রমরমা চোরাচালান ও জমজমাট চাঁদাবাজি। তবে চোরাকারবারীর চেয়ে চাঁদাবাজদের সংখ্যাই বেশি।
নেহালের নেতৃত্বে আওয়ীমী আমলের চেয়ে আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠেছে বিএনপি যুবদল নামধারী চাঁদাবাজরা। সীমান্ত জুড়েই চোরাচালান ও চাঁদাবাজি চলছে নেহালের ইশারাতে। সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক নেতা ও বর্তমান গোয়াইনঘাট উপজেলা বিএনপির সদস্য বরখাস্তকৃত ইউপি চেয়ারম্যান আরিফ ইকবাল নেহাল গোয়াইনঘাট সীমান্তে গড়ে তুলেন নতুন করে একটি চাঁদাবাজ চক্র। সেই চক্রের প্রায় ৫০ জন লাইনম্যান পুরো উপজেলা জুড়ে চালাচ্ছে চাঁদবাজির মহোৎসব। বিএনপি নেতা আরিফ ইকবাল নেহাল ছিলেন গোয়াইনঘাট উপজেলার ৯নং ডৌবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান। এ সময় ২০১৯ সালে এলজিএসপির-৩ স্কীমের ১২ লক্ষ ৩ হাজার টাকা আত্মসাতের দায়ে তাকে বরখাস্ত করা হয়। এলাকা জুড়ে তিনি লুটেরা দুর্নীতিবাজ বলে চিহ্নিত হলেও দল থেকে তাকে বহিস্কার করেনি বিএনপি। বর্তমানে নেহাল নিজেকে বিএনপির ক্ষমতাধর সিনিয়র নেতা পরিচয়ে দাপটের সাথে উপজেলা জুড়ে চাঁদাবাজি ও চোরাচালান বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত ৫আগস্ট সরকার পতনের পরই নেহাল সিলেট নগরীর আম্বরখানাস্থ একটি আবাসিক হোটেলে চোরাকারবারীদের সাথে গোপন বৈঠক করেন নেহাল। এরপর থেকে শুরু হয় বুঙ্গার (চোরাচালানের) লাইন দখল আর চাঁদাবাজি। প্রথমেই তিনি উপজেলার শীর্ষ লাইনম্যান সামছুল উরফে কালা সামছু, কালা মিয়া উরফে শ্যামকালা ও তার সহযোগী আল-আমিনকে কৌশলে হাত করে নেন। এরপর থেকে সিলেট নগরীর বারুতখানাস্থ একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান করে সেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করছেন চোরাচালানের মিশন।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) উপজেলার ফতেহপুর বাজারে এক সভা হয়। সেখানে বক্তারা আরিফ ইকবাল নেহালকে কঠোর হুশিয়ারী প্রদান করে বলেন, গোয়াইনঘাট থানা পুলিশের প্রতিটি ভিট অফিসারদের সাথে নেহালের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। যার ফলে তিনি উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে তাহার নিজস্ব মানুষ সেট করে রেখেছেন। উপজেলাবাসীর কাছে এরা লাইনম্যান হিসাবে চিহ্নিত এবং পুলিশের অবৈধ আয়ের হাতিয়ার।
বক্তারা আরো বলেন, আরিফ ইকবাল নেহাল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অবৈধ সুবিধা নেওয়ার জন্য গোয়াইনঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ইব্রাহিম আলীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগে যোগদানের চেষ্টাও করেন। তখন আওয়ামী লীগে যোগদানের প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় তিনি যোগ দিতে পারেননি। তবে এর আগেও আওয়ামী লাইনম্যানদের সাথে তার গভীর সখ্যতা ছিল বলে বক্তারা অভিযোগে করেন।
এদিকে সরকার পথনের পর সীমান্ত এলাকার চোরাচালানের একক নিয়ন্ত্রন নিয়ে যায় বিএনপি নামধারী একটি চক্র। যারা বরখাস্তকৃত সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপি থেকে বহিস্কৃত বিএনপি শাহ আলম স্বপনের একান্ত আপনজন। স্থানীয়দের মতে চোরাচালানের পাশাপাশি ওপেন লুটপাটে অংশ নেন পূর্বজাফলং ইউনিয়নের যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ, পূর্বজাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজির উদ্দিন, গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ্ আলম স্বপনের পিএস মিজানুর রহমান হেলোয়ার, সাবেক চেয়ারম্যান স্বপনের বডিগার্ড ইসলাম উদ্দিন।
যার দায় পড়তে শুরু করে গোটা উপজেলা বিএনপির উপরে। যদিও বিএনপির ত্যাগী কোন নেতাকর্মী এমন লুটপাটে জড়িত নয় বলে স্থানীয় লোকজন জানান। সাবেক সরকারে আমলে মন্ত্রীর কাছে থাকা সুবিধাভোগীরাই এসব লুটপাট চালায়, এবং তারা এখনো রাতে দিনের জাফলংয়ে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে।
এ দিকে পুলিশ বিজিবির নিষ্কৃয়তায় সীমান্ত জনপদ সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় চোরাচালানকারী চাঁদাবাজ চক্রের সদস্যরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কিছুতে থামছে না চোরাচালান। বন্ধ হচ্ছে লাইনম্যানদের চাঁদাবাজি। আর এই লাইনম্যানরাই হচ্ছে থানা পুলিশের অবৈধ আয়ের হাতিয়ার। যার ফলে থানা পুলিশ নিরব ভূমিকা পালন করছে। বাধ্য হয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার তৌহিদুল ইসলাম নিজে আনসার সদস্যদের নিয়ে চোরাচালানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছেন।