বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্ক দুশ্চিন্তায় ভারত !
দিল্লিকে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা।ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে হামলা ও পতাকা পোড়ানোর পর এই প্রতিবাদ জানায় ঢাকা ।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গত দেড় দশকে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক যে উচ্চতায় পৌঁছানোর কথা বলা হতো ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে পতন হয়েছে সেই সম্পর্কের। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক মোটামুটি সচল থাকলেও ভিসা বন্ধ। জনসাধারণ পর্যায়েও সম্পর্কের একটা বড় অবনতি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ বিরোধী সব রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় সংগঠন ও ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে দেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
বাংলাদেশের অবস্থান
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে হামলার পর ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে । ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন আলাদা আলাদা কর্মসূচি দিয়েছে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছে। মঙ্গলবার শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পর্যন্ত প্রতিবাদী মিছিল করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। গণঅভ্যুত্থানের নেপথ্যে থাকা গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি ভেঙে দিয়ে নতুন এ সংগঠনটি তৈরি হয়েছে।
প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিলে সামনের সারিতে অংশ নেওয়া তাজনুভা জাবিন বলেন, ‘সীমান্ত হত্যা, পানির হিস্যা বিভিন্ন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের একটা নতজানু নীতি ছিল। আগের মতো যে তাদের (ভারত) অধীনস্ত বা তাদের আধিপত্য এটা এখন আর থাকবে না। আমরা কিন্তু তাদের সঙ্গেশত্রুতা চাই না। আমরা তাদের সঙ্গে সমান সমান বন্ধুত্ব চাই।
সংগঠনের সদস্য সচিব আখতার হোসেন শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ায় ভারতের সমালোচনা করে বলেন, ‘হাসিনা প্রায় দুই হাজার মানুষকে খুন করে ভারতে আশ্রয় পেয়ে আছে। এরকম ধরনের একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এই সময়টাতে যাচ্ছে। আমরা চাইবো এই জায়গায় যেন স্থিতিশীলতা বজায় থাকে, ভারত যেন হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। আর আমরা চাই ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি আছে সেসব চুক্তি যেন আবার রিভিউ করা হয়।
বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সেটি অনেক ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখা হচ্ছে বাংলাদেশে। ভারতে জনগণ এবং সরকার এবং জনগণ যেভাবে বাংলাদেশকে দেখছে সেটির সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই বলেও বাংলাদেশ দাবি করছে। এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় বিভিন্ন কূটনীতিক মিশন ও রাষ্ট্রদূতদের ব্রিফিং করেছে সরকার।
ভারতের উদ্বেগ কোথায়
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের ভারত বিরোধী একটা অবস্থান এবং এর প্রকাশ দেখা গেছে। ভারতের সেভেন সির্স্টার্সকে টার্গেট করে বক্তব্য, হুঁশিয়ারি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হওয়ায় উদ্বেগ ও উত্তেজনা তৈরি হয়েছে ভারতে।
ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করছেন বহু বছর ধরে। মিজ দত্ত অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার প্রসঙ্গে ভারতের ভাবনা কেমন সেটা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘ফ্রম ইন্ডিয়ান পয়েন্ট অফ ভিউ ইন্টেরিম গর্ভমেন্ট, এটাতো একটা এক্সপেরিমেন্টাল গর্ভনমেন্ট, এটাতো কনস্টিটিউশনালি ম্যান্ডেটেড না।
তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা কমফোর্ট জোনতো ছিল। সেই কমফোর্ট জোনটা কোথাওতো মনে হচ্ছে সরে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ চলে যাওয়াতে আমাদের মেইন দুর্বলতা হচ্ছে যে আমাদের যে সিকিউরিটি কনসার্নগুলো অন্য কেউ বুঝবে কি না। সেটার একটা হিস্ট্রি আছে ধরুন ২০০১-০৬ সেই সময়ের কথা বলছি। সেই সময়ে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে যে সম্পর্কটা সেটা আমি ত্রিশ বছরে বলবো সবচে খারাপ ছিল।
শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ‘রাইট মেসেজ বা সিগন্যাল পাচ্ছি না যে ওখানে সবকিছু আন্ডার কন্ট্রাল। মানে কোথাও যেন মনে হচ্ছে গর্ভনমেন্ট ম্যানেজ করতে পারছে না। একই সঙ্গে কেউ যদি একটা বিবৃতি দেয় যে ভায়োলেন্সগুলো দেখানো হচ্ছে সেগুলো ঠিক না। আজকাল যেটা হয়েছে প্রবলেম সোশ্যাল মিডিয়াতেতো বন্যা বয়ে যাচ্ছে চারিদিকে।
দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ‘ধর্ম নিয়ে যেটা চলছে সেটা খুবই স্পর্শকাতর। একদিকে আমরা যেটা দেখেছি ফিফথ অগাস্টের পর একটা ভায়োলেন্সের জায়গা। সেটাতো আমাদের স্বাভাবিকভাবেই খুব একটা আশঙ্কা তৈরি করেছিল। তারপর এখন যেটা দেখছি সংখ্যালঘু নিয়ে। দুটো দেশের মধ্যে রিলিজিয়ন নিয়ে যেটা চলছে টানাপোড়েন এটা কিন্তু হওয়ার কথা না দুই ফ্রেন্ডলি নেবারের সঙ্গে। আর দুজনকে দুজনের দরকার। তো আমরা সম্পর্ক কেন সুন্দর রাখবো না।
মিজ দত্ত বলেন, যখন পাকিস্তান আবার বাংলাদেশে নরম্যালসি হচ্ছে তার মানে তারা আবার চেষ্টা করবে যে কী করে অ্যান্টি ইন্ডিয়া কিছু অ্যাকটিভিটি করা যায় থ্রু বাংলাদেশ। সেরকম একটা আশঙ্কা। তারপর কোথাও একটা রিপোর্ট এসেছিল যে সার্টেন একটা অ্যামিউনেশন কেনার কথা পাকিস্তান থেকে। সেটাও একটা আশঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছিল। তারপর আমরা দেখলাম যেটা একশ বছরে হয়নি জিন্নাহর জন্মদিন সেলিব্রেট করেছে।
এদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে ভিত্তিহীন তথ্য, নানারকম গুজব ছড়াতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংখ্যালঘু এবং হিন্দুদের ওপর হামলা এবং অত্যাচারের নানা রকম তথ্য, অপতথ্য এবং গুজব ব্যাপকভাবে প্রচার হতে দেখা গেছে।
মিজ দত্ত বলেন, ‘সেটার অনেক কারণ। তার মধ্যে সবচে প্রবলেম ছিল ভায়োলেন্ট অ্যাকটিভিটিজ, টেরর অ্যাটাকস। নট অনলি ফ্রম উইদিন বাংলাদেশ বাট অন্য এক্সটার্নাল পাওয়ার চেষ্টা করেছে যেটা আমাদের কাছে ইনফরমেশন আছে।
এ গবেষক জানান, সরকার পতনের পর অভ্যুত্থানকারী ছাত্রনেতা এবং বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায় থেকে ভারত যে যে বার্তা পেয়েছে সেটি নিয়ে তাদের অস্বস্তি আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আগে ভারতের নর্থ-ইস্টে ইনসার্জেন্ট অনেকগুলো ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল বিষয়টি নিয়ে একটা আশঙ্কাতো আছে।
এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের গতি প্রকৃতি ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কারণ বর্তমান সরকারের সময়ে পাকিস্তান থেকে সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ বাংলাদেশে এসেছে।
দু’দেশের জনগণের সম্পর্কে অবনতি
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলেছেন পাঁচ তারিখের আগে এবং পরের সরকারের মধ্যে তফাৎ আছে এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘পাঁচ তারিখ একটা ওয়াটারমার্ক। অবশ্যই এর পরের সম্পর্ক আর আগের সম্পর্ক এক না। এটা আমরা জানি এবং এই সমস্যাটা স্বীকার করতে হবে। স্বীকার করি আমরা। একটা সমস্যা স্বীকার করলে সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা যায় এবং চেষ্টা করাই স্বাভাবিক। আমরা ভারতের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক ভালো সুসম্পর্ক চাই পরস্পরের স্বার্থ ঠিক রেখে।
ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েনের সবচে উদ্বেগের বিষয় হলো ভারত-বাংলাদেশ জনগণের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতির দিকটি। ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির মনে করেন দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্কের এই নেতিবাচক অবস্থাটি নজিরবিহীন।
এম হুমায়ুন কবির বলেন, জনগণের পর্যায়ে সম্পর্কের যে উত্তেজনা তারই প্রতিফলন হলো ভারতে বাংলাদেশ মিশনে হামলা এবং বাংলাদেশজুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ। দুই দিকেই কেমন যেন একটা সাজ সাজ রব মনে হচ্ছে এবং সেটা প্রধানত জনগণ পর্যায়ে। জন উত্তেজনার একটা নতুন জায়গা তৈরি হয়েছে যেটা কিন্তু আশঙ্কার কারণ। কেন আশঙ্কা কারণ হলো, এতে করে ভারতে বাংলাদেশিদের কোনো হোটেলে থাকতে দিচ্ছে না। সীমান্তে এসে ভারতীয়রা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে বা বাংলাদেশ ঢুকবার চেষ্টা করছে, পণ্যসামগ্রী আদান প্রদানে বাধা প্রদানের চেষ্টা করছে। এইগুলো হলো আমার কাছে মনে হয় আশঙ্কার জায়গা।
তিনি বলেন, সার্বিকভাবে দুদেশের সম্পর্কের গতি প্রকৃতি এখন নেতিবাচক বার্তাই দিচ্ছে। ভারত ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে মেজেস যেটা যে ভারত আমার বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সহযোগী হতে রাজি নয়। মেসেজটা এখনো নেতিবাচক রয়ে গেছে ভিসা না দেওয়ার কারণে। অন্যান্য সার্ভিসগুলো হচ্ছে না সেগুলো নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। আগরতলাতে আমরাও অফিস বন্ধ করে দিয়েছি ওখানেও একইরকমভাবে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে যে বাংলাদেশ আর আমাদের ভিসা দেবে না।
৫ অগাস্ট পরবর্তী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলাপ আলোচনার জায়গাটিও সংকুচিত হয়ে গেছে বলে পর্যবেক্ষকরা বলছেন। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আলাপ আলোচনা দরকার বলে উল্লেখ করে এম হুমায়ুন কবির।
দু’দেশের মধ্যে আলাপ আলোচনার ঘাটতি এবং পতাকা অবমাননা প্রসঙ্গে ভারতের বিশ্লেষক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ‘দুই দেশের সরকার এটা সাপোর্ট দেয় না। দেখুন সব দেশেই কিছু দুস্কৃতিকারী থাকে। তারা ন্যারেটিভটাকে অন্যদিকে নিয়ে যায় এবং পুরো জিনিসটাকে কী রকম একটা ঘোলাটে করে দেয়। আমার যেটা সবচে বেশি ফিলিং এখন যে পরিস্থিতিটা যে একটা সার্টন ভেস্টেড কোয়ার্টার এটা চাইছে না যে ইন্ডিয়া বাংলাদেশে সুস্থ্য সবলভাবে একসঙ্গে এনগেজ করুক।
তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিক ক্ষেত্রে যে ধরনের সরকারি বেসরকারি জনগণ পর্যায়ে যোগাযোগগুলি হয় সবগুলি যোগাযোগ কিন্তু স্থবির হয়ে আছে। কাজেই এগুলোকে আবার চালু করা দরকার। তবেই আস্তে আস্তে সম্পর্কটা আবার স্বাভাবিক জায়গায় আসবে। একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আমাদের জন্য দরকার একইভাবে ভারতের জন্য দরকার। কারণ বাংলাদেশকে ঘিরে তার নিরাপত্তার বিষয় আছে, তার ব্যবসা বাণিজ্য আছে, তার বিনিয়োগ আছে তার ভূরাজনীতি আছে। সবগুলো ক্ষেত্রেই যদি বাংলাদেশ যদি তার সঙ্গে সহযোগী না হয় বা সহযোগিতা না করে তাহলে সেগুলো ভারতের জন্যই নতুন করে জটিলতা তৈরি করবে। এই বাস্তবতার আলোকেই আমি মনে করি বাংলাদেশ এবং ভারতের দুই দেশের নেতৃবৃন্দের এই উত্তেজনা প্রশমনে সক্রিয় হওয়া দরকার।
আগরতলায় হামলার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে প্রতিবাদ করে। সেখানে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে প্রণয় ভার্মা বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের সহযোগিতার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। আমাদের সম্পর্ক ব্যাপক ও বহুমুখী। এটি একটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দুই দেশের মধ্যে অনেক আন্তঃনির্ভরতা রয়েছে। আমরা এই নির্ভরতাগুলোকে পারস্পরিক কল্যাণের ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে চাই।বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে সেভেন সিস্টার্স, হিন্দু ও পাকিস্তান নিয়ে চিন্তিত ভারত ।
-বিবিসি।