রাইজিংসিলেট- নতুন ‘খেলোয়াড়’ নামলেন রাজনীতির ময়দানে: ইলন মাস্কের দল কি বদলে দেবে যুক্তরাষ্ট্র? নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেন ইলন মাস্ক, নাম দিলেন ‘আমেরিকা পার্টি’ বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও টেসলা এবং স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। ‘আমেরিকা পার্টি’ নামের এই দলটির লক্ষ্য হবে জনগণের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনা। স্থানীয় সময় শনিবার (৫ জুলাই), মাস্ক তার নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ (পূর্বতন টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে এ ঘোষণা দেন।
মাস্ক লিখেছেন, “আজ ‘আমেরিকা পার্টি’র জন্ম হলো। এ দলের মূলে রয়েছে নাগরিক স্বাধীনতা, সৎ নেতৃত্ব ও ব্যয়ের জবাবদিহি নিশ্চিত করার অঙ্গীকার। এই দল গঠনের মাধ্যমে আমি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের হাতে রাজনৈতিক ভারসাম্য ও বিকল্প ফেরত দিতে চাই।”
মাস্কের আগাম ইঙ্গিত ও জনমত জরিপ- নতুন দল গঠনের সিদ্ধান্ত আকস্মিকভাবে আসেনি। গত কয়েক মাস ধরে মাস্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন একটি বিকল্প রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলে আসছিলেন। কয়েক দিন আগে তিনি এক্স-এ একটি জনমত জরিপ চালান, যেখানে তিনি জানতে চান, “যুক্তরাষ্ট্রে নতুন একটি রাজনৈতিক দল কি প্রয়োজন?” ওই জরিপে প্রায় ১২ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করে, যার মধ্যে প্রায় ৬৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী নতুন রাজনৈতিক দলের পক্ষে মত দেন।
এই ফলাফল পাওয়ার পরপরই মাস্ক নতুন দল গঠনের ঘোষণা দেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি ছিল জনসাধারণের মনোভাব যাচাই করার একটি কৌশলী পদক্ষেপ, যার ভিত্তিতেই তিনি নিজের রাজনৈতিক পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।
ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন- ইলন মাস্ক এক সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সরকারি দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন এবং ট্রাম্পের ২০২০ সালের নির্বাচনী প্রচারেও আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি দেশটির অর্থনৈতিক নীতিমালা নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়।
মূল বিরোধের সূত্রপাত ঘটে ‘বিগ বিউটিফুল বিল’ নামে পরিচিত একটি করছাড় ও ব্যয় বৃদ্ধির বিল নিয়ে। বিলটি ট্রাম্প সম্প্রতি আইনে পরিণত করেন। মাস্ক এই বিলের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “এই বিল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামোকে বিপর্যস্ত করে দেবে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও করছাড়ের মাধ্যমে দেশের রাজস্ব কমে যাবে এবং ঋণের বোঝা বাড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “যেসব আইনপ্রণেতা এই বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন, আমি তাদের নির্বাচনে হারাতে নিজের অর্থ ব্যয় করব। যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রক্ষায় এখন সময় এসেছে নাগরিকদের জাগরণের।”
রাজনৈতিক প্রতিশোধ নাকি নীতিগত অবস্থান?
ইলন মাস্কের নতুন দল গঠনকে কেউ কেউ রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবেও দেখছেন। ট্রাম্প শিবিরের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, মাস্কের এই পদক্ষেপকে তারা ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখছে। একাধিক গণমাধ্যম সূত্র অনুযায়ী, ট্রাম্প ইতিমধ্যে মাস্কের বিভিন্ন কোম্পানির ওপর ভর্তুকি ও সরকারি সহযোগিতা বাতিলের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে বলেছেন।
বিশেষ করে স্পেসএক্স ও টেসলা—যেসব প্রকল্প কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে কোটি কোটি ডলারের ভর্তুকি পায়—সেগুলোর ওপর সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মাস্ক ও ট্রাম্পের এই প্রকাশ্য বিরোধ আগামী নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
আমেরিকা পার্টির লক্ষ্য ও অবস্থান- ইলন জানান, তার দল একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হবে, যেখানে চরমপন্থা বা দলীয় আদর্শবাদ নয়, বরং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। দলটি এমন একটি কাঠামো চায়, যেখানে স্বাধীনতা, সীমিত সরকার, দক্ষ ব্যয় ও প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে নাগরিক সেবার মান বাড়ানো হবে।
তিনি আরও বলেন, “আমরা কোনো বিশেষ দলের বিরুদ্ধে নয়, বরং এমন এক রাজনৈতিক শক্তি গড়তে চাই, যা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত- যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় রাজনৈতিক দল সফল হওয়ার ইতিহাস খুবই কম। তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইলন মাস্কের মতো একজন বিতর্কিত হলেও প্রভাবশালী ব্যক্তি যদি সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক মাঠে নামেন, তবে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের দুইদলীয় ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘস্থায়ী চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড্যানিয়েল ফিলিপস বলেন, “মাস্কের মতো একজন ধনকুবের যিনি প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা করেন, তিনি যদি রাজনৈতিক মঞ্চেও নতুন ধারা আনতে পারেন, তবে সেটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হবে।”
এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া নেই হোয়াইট হাউস বা ট্রাম্প শিবিরের পক্ষ থেকে
মাস্কের এই ঘোষণার পর এখনও হোয়াইট হাউস বা ট্রাম্পের অফিস থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, মাস্কের নতুন দলের কার্যক্রম এবং তার ভবিষ্যৎ পদক্ষেপকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন উত্তাপ সৃষ্টি হবে।
ইলন মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে কিংবা আদৌ দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারবে কি না, তা ভবিষ্যতের বিষয়। তবে এতটুকু নিশ্চিত, যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাস্কের এই পদক্ষেপ রাজনীতির মাঠে বড় ধরনের আলোড়ন তুলেছে।