নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাজবাড়ীর পাংশা থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত পদ্মা নদীর ৫৭ কিলোমিটার এলাকায় অবাধে মা ইলিশ শিকার করে যাচ্ছেন জেলেরা।
পদ্মাপাড়ে অস্থায়ী হাট বসিয়ে এসব মাছ বিক্রিও করা হচ্ছে প্রকাশ্যে। দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা আসছেন সস্তায় ইলিশ কিনতে।
জেলেদের দাবি, নিষেধাজ্ঞার সময় সরকারি সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অধিকাংশ জেলে। আবার যারা পাচ্ছেন তাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ কারণে পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে মাছ শিকারে নেমেছেন তারা।
আর মৎস্য কর্মকর্তা বলছেন, জনবল সংকটের কারণে সব এলাকায় নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও মা ইলিশ রক্ষায় সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন তারা।
বুধবার (২৩ অক্টোবর) দুপুরে সরেজমিনে রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকায় পদ্মা নদীতে জেলেদের নৌকা নিয়ে মাছ শিকার করতে দেখা গেছে।
গোয়ালন্দ থেকে মাছ কিনতে আসা ইছাক শেখ বলেন, স্বাভাবিক সময়ে যে মাছের দাম ৩ হাজার টাকা কেজি সেই মাছ এখন জেলেরা অর্ধেক দামে বিক্রি করছেন। যে কারণে এখান থেকে সস্তায় কয়েক কেজি মাছ কিনলাম।
জেলে রাজু বিশ্বাস বলেন, রাজবাড়ীতে ১৪ হাজার জেলে রয়েছেন। কিন্তু সরকার চাল সহায়তা দিয়েছে মাত্র ৪ হাজার জনকে। তাও মাত্র ২৫ কেজি করে চাল দিয়েছে। আমরা অধিকাংশ প্রকৃত জেলেরাই এই চাল পাইনি। তাই পেটের তাগিদে বাধ্য হয়েই জাল নিয়ে নদীতে নামতে হচ্ছে।
দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের কাওয়ালজানি গ্রামে পদ্মা পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ইলিশের অস্থায়ী হাট বসেছে। জেলেরা নদী থেকে ইলিশ শিকার করে এনে এই হাটে বিক্রি করছেন। দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা এসেছেন ইলিশ কিনতে। এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশগুলো জেলেরা ১ হাজার ৪০০ টাকা ও ছোট (জাটকা) ইলিশ মাছ ৫৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন জেলেরা। তবে এ সময় নদীতে মৎস্য বিভাগের কাউকে অভিযান চালাতে দেখা যায়নি।
আরেক জেলে রেজাউল মণ্ডল বলেন, আমি ২৫ কেজি চাল পেয়েছি। কিন্তু এই সামান্য চাল দিয়ে কয়দিন সংসার চলে। আর শুধু চাল দিয়ে ভাত রান্না করে তো খাওয়া যায় না। আনুষঙ্গিক অনেক বাজার-সদাই লাগে। তার ওপর আবার কিস্তির চাপ আছে। তাই বাধ্য হয়ে মাছ ধরতে হচ্ছে।
এদিকে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়েও দৌলতদিয়া ফেরিঘাট, লঞ্চঘাট, চলন্ত ফেরি ও লঞ্চে প্রকাশ্যে ব্যবসায়ীদের ডালিতে করে ইলিশ বিক্রি করতে দেখা গেছে।
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজবাড়ীর পাংশা থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত পদ্মা নদীর ৫৭ কিলোমিটার এলাকা মা ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র। ১৩ অক্টোবর থেকে আজ (২৩ অক্টোবর) পর্যন্ত এসব এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫৬ জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও ৫৭ হাজার ৪০০ টাকা জরিমানা আদায়ের পাশাপাশি জব্দ করা হয়েছে ছয় লাখ ১৬ হাজার মিটার জাল ও ৬৮৭ কেজি ইলিশ। জব্দ করা ইলিশ স্থানীয় বিভিন্ন এতিমখানায় দান করে দেওয়া হয়েছে।
সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোস্তফা আল রাজীব বলেন, জনবল সংকটের কারণে সব এলাকায় নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও আমরা মা ইলিশ রক্ষায় সাধ্যমতো অভিযান পরিচালনা করছি। পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা আমাদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করছেন। প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত নদীতে আমাদের একটি টিম কাজ করে। আবার বিকেল ৩ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত একটি টিম কাজ করে। এভাবে স্পিডবোট নিয়ে প্রতিনিয়ত আমরা নদীতে টহল দিচ্ছি। যেসকল জেলেরা মাছ ধরছেন তাদের ভিজিএফসহ অন্যান্য সুবিধা বাতিল করা হচ্ছে। এছাড়াও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের জেল, জরিমানা করা হচ্ছে। তাদের থেকে জব্দ করা জাল পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।
রাজবাড়ী জেলা মৎস্য অফিসার না থাকায় সেখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছে সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোস্তফা আল রাজীব। এছাড়া দীর্ঘদিন গোয়ালন্দ উপজেলাতে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা না থাকায় তিনি একই সঙ্গে গোয়ালন্দ উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন।
অর্থাৎ রাজবাড়ী জেলা অফিস, রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তার তিনটি পদের দায়িত্ব তিনি একাই পালন করছেন। একই সঙ্গে তিনটি দফতর দেখভাল করায় তিনি কতটুকু নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন এ বিষয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) সিদ্ধার্থ ভৌমিক বলেন, ইলিশ মাছ বিক্রির বিষয়টি আমি শুনেছি। মৎস্য অফিসারকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। মা ইলিশ রক্ষা করতে আমাদের অভিযান চলছে।