মো. লোকমান হেকিম:: ভেক্টর হচ্ছে কোনো আর্থপোডাবা কোনো ক্ষুদ্র প্রাণী, যারা রোগের জীবাণু বহন করে অন্যর মধ্যে সংক্রামিত করে থাকে।
বাংলাদেশে মশা ও মাছি হচ্ছে উল্লেখযোগ্য ভেক্টর, যাদের মাধ্যমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর রোগ মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে থাকে। তাই রোগমুক্ত সুস্থ জীবন ধারণের জন্য মশা ও মাছিমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা একান্ত জরুরি। এ ব্যাপারে শুধু রাষ্ট্রই নয়- রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তি সবাইকেই একযোগে কাজ করতে হবে এবং সবাইকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নিচে মশা ও মাছি বাহিত কিছু রোগএ বং এ ব্যাপারে আমাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হলো।
মশাবাহিত রোগ এবং করণীয়- মশার মাধ্যমে সাধারণত যেসব রোগ ছড়ায় তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, ইয়েলোফিভার, জাপানিজ এনকেফালাইটিস, চিকুন গুনিয়া ফিভার।এগুলোরমধ্যে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুও ফাইলেরিয়া রোগ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশে এই তিন ধরনের রোগী প্রচুর পাওয়া যায়।স্ত্রী এনাফিলিস মশা দিয়ে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। বাংলাদেশে গারো, খাসিয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকা ইত্যাদি এলাকায় এই রোগ বেশি দেখাযায়। তবে যেসব এলাকায় গরিব মানুষ, গ্রাম, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন এলাকা এসব এলাকার লোকজনের মধ্যেও এই রোগ বেশি দেখা যায়। শুধু মশার কামড়েই নয়, রক্ত পরিসঞ্চালন এবং মায়ের গর্ভ ফুলের মাধ্যমেও নবজাতকের মধ্যে এই রোগ সংক্রামিত হতে পারে। সাধারণত শুষ্ক মওসুমে এই রোগ কম হয়। বর্ষা মওসুম, স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া এই রোগের প্র্রাদুর্ভাবের উপযোগী সময়।ডেঙ্গু জ্বরের মশাগুলো সাধারণত দিনে কামড়ায়। এডিস ইজিপ্ট নামক মশা দিয়ে এই রোগ ছড়ায়।
এরা সাধারণত বর্ষাকালে এবং অধিক আর্দ্রতাপূর্ণ আবহাওয়ায় বংশবিস্তার করে। এরা সাধারণত ১৫ থেকে ৬৫ দিন বাঁচে এবং এরা এদের জীবনকালে সারাজীবনই মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে।
কিউলেস মশার কামড়ের মাধ্যমে ফাইলেরিয়া রোগ ছড়ায়। তবে কিউলেস, এনাফিলিস ও এডিস- তিন ধরনের মশা দিয়েই বিভিন্ন ধরনের ফাইলেরিয়া রোগ ছড়াতে পারে।করণীয়-সুতরাং এই ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ও ফাইলেরিয়া রোগমুক্ত সমাজ গড়তে হলে আমাদের মশামুক্ত সমাজ গড়তে চেষ্টা করতে হবে এবং মশামুক্ত সমাজ গড়তে পারলেই আমরা এই রোগগুলো থেকে বহুলাংশে মুক্ত থাকতে পারব।
সেজন্য আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় নিচে উল্লেখ করা হলো-১. পরিবেশ প্রতিরোধবাএন ভায়রনমেন্টাল কন্ট্রোল:এরমাধ্যমে আমরা মশার প্রজনন বহুলাংশেক মিয়ে আনতে পারি। পরিবেশকে পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে হবে।
ক. যেসব জায়গায় ডেঙ্গু মশা বিস্তার লাভ করে এবংবসবাস করে সেগুলো হচ্ছে- * গাছেরছিদ্র, বাঁশেরছিদ্র, *ফুলদানি, কৌটা, ড্রাম, নারকেলের খোসা, বোতল। * ফ্রিজের তলার পাত্রবা অংশ * টায়ারের অংশ ইত্যাদি।
সুতরাং ডেঙ্গু মশা প্রতিরোধে এসব জায়গায় যাতে ক্ষুদ্রচলনহীন পানি না জমে সেদিকে সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে এবং পয়োজনীয়ব্যবস্থা নিতেহবে।
খ. ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য ডোবানালা, পুকুর, ড্রেন ইত্যাদিতে মশা যাতে ডিম পেড়ে বংশবৃদ্ধি না করে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এসব জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং নিয়মিত মশানিধনকারী ওষুধ স্প্রে করতে হবে।২. মশা রিব্যবহার করতে হবে।৩. নিয়মিত মশা নিধনকারী ওষুধ স্প্রে করতে হবে।৪. সবার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
মাছি বাহিত কিছু রোগ এবং করণীয়- মাছির মধ্যে সাধারণত যেসব রোগ ছড়ায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-টাইফয়েড এবং প্যারাটাইফয়েড, ডায়রিয়া,আমাশয়,কলেরা,ফুডপয়জনিং (খাদ্যে বিষক্রিয়া),কৃমিজনিত রোগ,কালাজ্বর। কালা জ্বর ছড়ায় এক ধরনের স্যান্ডফ্লাইয়ের মাধ্যমে। হাউজ ফ্লাই সাধারণত তিন ভাবে রোগ জীবাণু ছড়ায়। * তার পায়ের সাহায্যে এক খাদ্য থেকে জীবাণু বহন করে অপর খাদ্যে সংক্রামিত করে। বমির সাহায্যে-মশা পুনঃপুনঃ বমির মাধ্যমে খাদ্যে রোগ জীবাণু সংক্রামিত করে থাকে- যেখাদ্য খেয়ে মানুষ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। * পায় খানার মাধ্যমে- মশা পুনঃপুনঃ পায় খানার মাধ্যমে খাদ্যে জীবাণু ছড়ায়- সেসব খাদ্য খেয়ে মানুষ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়।স্যান্ডফ্লাই হচ্ছে এক ধরনের ছোটমাছি, সেটি হাউজফ্লাইবাঘরে যে মাছি দেখা যায় তার চেয়েও ছোট। এরা সাধারণত রাতে বেরহয় এবং দিনে সাধারণত গর্ত, গাছের গর্ত, দেয়ালের ফুটো, অন্ধকার কক্ষ, স্টোররুমে লুকিয়ে থাকে। এরা রক্ত চোষা মাছি। শুধু স্ত্রী স্যান্ডফ্লাই গুলোই কামড়ায় এবংবাংলাদেশে এই মহিলা স্যান্ডফ্লাইয়ের কামড়ের মাধ্যমেই কালাজ্বর হয়ে থাকে।এ ছাড়া সিসিফ্লাই নামে আরো এক ধরনের রক্তচোষা মাছি আছে, যেগুলো দেখতে ঘরের সাধারণ মাছির মতোই। এটা বাংলাদেশে পাওয়া যায়না। এটি শুধু আফ্রিকা মহাদেশেই পাওয়া যায়। এ মশা গুলো সাধারণত ঘরের মধ্যে ঢোকে না। তবে এরা ভ্রমণকারীদের রাস্তায়, ট্রেনে বা বিভিন্ন বাহনে বহু দূর পর্যন্ত অনুসরণ করে থাকে শুধু রক্ত চোষার নেশায়।
এই মশার কামড়ে স্লিপিং সিকনেস নামক এক ধরনের রোগ হয়ে থাকে।মাছি বাহিত রোগ প্রতিরোধে করণীয়- মাছি প্রতিরোধের মাধ্যমে আমরা মাছি বাহিত রোগগুলো থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারি। নিচে কিছু করণীয় উল্লেখ করা হলো-
* ময়লা-আবর্জনা, রান্না ঘরের ময়লা ইত্যাদি খোলা জায়গায় না ফেলে ঢাকনা যুক্ত ড্রাম বা পাত্রে রাখতে হবে। এগুলো উন্মুক্ত ফেলে রাখা যাবে না। পরবর্তীকালে এগুলো সমন্বিত ভাবে সংগ্রহকরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে অথবা পুঁতে ফেলতে হবে।
* খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ না করে সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার ব্যবস্থা করতে হবে।
* ঘরের মেঝে, আঙিনায় ফিনাইল বা লাইজল দিয়ে নিয়মিত ধৌত করতেহবে।
* খোলা উন্মুক্ত খাবার এবং মাছি বসছে- এমন খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
* খোলা ও উন্মুক্ত খাবার বিক্রি বন্ধ করতে হবে।