রাইজিংসিলেট- মৌলভীবাজার জেলার ২২ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবার ভরসা সদর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের একমাত্র লিফটি আটমাস ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে চিকিৎসা নিতে আসা সেবাপ্রার্থী অসুস্থ রোগীরা। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার গর্ভবতী নারী, শিশু ও বয়স্করা।
সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের আগষ্ট থেকে চলতি বছরের মার্চে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে হাসপাতালের সচল লিফটি। নতুন বিল্ডিংয়ের পঞ্চমতলার ঊর্ধ্বমূখী সম্প্রসারণ সহ নানা সংস্কার কাজ চলমান থাকায় পঞ্চমতলার সাথে লিফটির সংযোগ বৃদ্ধির কারণে সচল লিফটের পাশেই নতুন করে আরেকটি লিফটি বসানোর কাজ শুরু হয়। গণপূর্ত অধিদফতরের তত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০২৩ সালের আগষ্ট থেকে কাজ শুরু করে। কথা ছিল ওই বছরের নভেম্বরে কাজ সম্পন্নের। কিন্তু বছর পেরিয়ে চলতি বছরের তিন মাস চলে গেলেও কাজের কোন অগ্রগতি নেই। অনেকটা ধীর গতিতে চলছে লিফট স্থাপনের কাজ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও নিশ্চিত করতে পারছেনা কবে চালু হবে লিফট।
হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের প্রবেশ মুখে সাঁটানো বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায় ভারপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক ও গণপূর্ত অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলীর পৃথক স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে লেখা রয়েছে ৩০ আগষ্ট থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত পঞ্চম তলার ঊর্ধ্বমূখি সম্প্রসারণের জন্য রোগীর সেবায় নিয়োজিত লিফটি বন্ধ থাকবে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের লিফট বন্ধ থাকায় ঝুঁকি নিয়ে স্ট্রেচারে বহন করে গর্ভবতী নারীদের স্বজনরা সিড়ি দিয়ে তৃতীয় তলার গাইনী ও চতুর্থ তলার মেডিসিন ওয়ার্ডে নিয়ে যাচ্ছেন। লিফটের বদলে এভাবে সিড়ি উঠতে গিয়ে গর্ভবতী নারী ও গর্ভে থাকা নবজাতকের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রোগীর স্বজনরা। এছাড়াও শ্বাসকষ্ট সহ নানা বয়স্কজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদেরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিড়ি বেয়ে স্ট্রেচারে করে উঠতে দেখা গেছে। অনেক রোগী স্ট্রেচার থেকে পরে উল্টো আহতও হচ্ছেন।
জানা যায়, জেলার সবচেয়ে বড় সরকারি এ স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশু সহ শত শত রোগী বিভিন্ন দূর্ঘটনা সহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী হাসপাতালটিতে প্রতিদিন নরমাল ও সিজারিয়ান মিলে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন গর্ভবতী নারী নবজাতক জন্ম দিচ্ছেন। নবজাতক জন্মের পর সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করার সময় লিফটের বদলে সিড়ি বেয়ে ভয় আর শঙ্কা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন এসব নারীরা। আর দ্বিতীয় তলার গাইনী অপারেশন থিয়েটারে গর্ভবতী নারীদের সিজার সম্পন্ন শেষে স্ট্রেচারে করে ৪ থেকে ৬ জন মানুষের সহায়তায় সিড়ি বেয়ে তৃতীয় তলার গাইনী ওয়ার্ড ও কেবিন নিয়ে যেতে হয়। যদিও এসব রোগীর ক্ষেত্রে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে চতুর্থ তলার মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন সদর উপজেলার উলুয়াইল গ্রামের ষাটোর্ধ বৃদ্ধা সানুর মিয়া। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারিনা, লিফট থাকায় আগে নামতে অসুবিধা হতো না। লিফট না থাকায় এখন ভয়ে কোনে প্রয়োজন হলে নামি না। আসছি পর থেকে বেডে আছি। হাসপাতালে আসা মানুষ রোগী নামিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন না, অনেক কষ্ট হয়। লিফটের কারণে আমার মতো অনেক রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এখন যদি কারো মৃত্যু হয় তাহলে তাঁর লাশটি কীভাবে নামাবেন এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, লিফট দেওয়া হলো রোগীদের কল্যাণের জন্য, তাহলে কি উপকারে আসছে।
তিনি আরও বলেন, আমার ভাই এর মৃত্যু হয়েছিলো, তাঁর লাশ সিঁড়ি বেয়ে নিতে হয়েছে। ভালোই উঠছিলেন তিনি। হার্টের রোগী ছিলেন, সিঁড়ি বেয়ে উঠার পূর্বেই তিনি মারা যান।
রক্ত সল্পতার কারণে ভর্তি হওয়া এক গৃহবধূর স্বামী কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরের আল-মামুন বলেন, লিফট বন্ধ থাকায় রোগী উঠানামায় অনেক অসুবিধা হয়। আমার চোখে দেখা ১২ বছরের শিশু সিড়ি দিয়ে উঠার সময় পড়ে যায়। লিফটটি যদি চালু থাকতো তাহলে শিশুটি এভাবে পড়তো না।
তিনি বলেন, অনেক রোগী তাঁর শারীরিক ওজন বেশি থাকায় উঠা-নামা করতে কষ্ট হয়। আমি সেদিন দুই-তিনজন রোগী নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তোলার সময় সাহায্য করেছি। আমি মনে করি এই লিফট দ্রুত কাজ না করা দায়িত্বে অবহেলার কারণ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার সদর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (উপপরিচালক) ডা: প্রণয় কান্তি দাস বলেন, যারা এই কাজের দ্বায়িত্বে রয়েছেন, তাদের আমরা বার বার তাগাদা দিচ্ছি, তারা বলছে দুই সাপ্তাহ সময় লাগবে লিফটের কাজ শেষ হতে। কাজ চলমান রয়েছে, মূলত টেকনিক্যাল কারণে দেরি হচ্ছে কাজ সম্পন্ন হতে।
মৌলভীবাজার গণপূর্ত অধিদপ্তরের সহকারি উপ প্রকৌশলী আব্দুল হেকিম বলেন, দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দেরি হওয়ায় কাজ সম্পন্ন করতে দেরি হচ্ছে। তিনি বলেন লিফটি চালু হতে আরও ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগতে পারে