বগুড়া প্রতিনিধি: বগুড়ার শেরপুরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাসিন্দাদের সাথে গ্রাামবাসীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয়পক্ষের নারী-পুরুষ মিলে অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। এরমধ্যে গুরুতর আহতদের অনেকেই শেরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
রবিবার (৮ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের আম্বইল গ্রামের ছাইফেলানী পুকুর পার এলাকায় দফায় দফায় এই সংর্ষের ঘটনা ঘটে। উভয় পক্ষের অভিযোগ সংঘর্ষের সময় পুলিশ উপস্থিত থাকলেও নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। এ ঘটনায় এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এ ঘটনায় শেরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা সুলতানা ও থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) আতাউর রহমান খোন্দকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, গত ৪ জানুয়ারি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠিদের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ এনে একই এলাকার ৪ গ্রামের লোকজন সংবাদ করেন। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে গত দুইদিন আগে আম্বইল গ্রামের সোলায়মান আলীর নেতৃত্বে স্থানীয় কতিপয় জমির মালিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির নেতা সন্তোষ সিংয়ের ৯ বি’ঘা আবাদী জমি দখলে নেয়। এরপর গত শুক্রবার রাতে কমপক্ষে ৫০টি মোটরসাইকেল নিয়ে তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের গোমরাতা ও বাগানপাড়া গ্রামে দেশীয় অস্ত্রসহ মহরা দেয়। এর প্রতিবাদে বগুড়ার সাতমাথায় মানবন্ধন করেছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা।
এদিকে রবিবার সকাল সাড়ে ৯ থেকে গ্রামবাসীর প্রায় তিন শতাধিক ব্যক্তি লাঠি, বল্লম, রাম দা, চাইনিজ কুড়াল নিয়ে জমির আশে পাশে সশস্ত্র অবস্থান নেয়। হামলার আশংকায় তারা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে সহযোগীতা চান নৃ-গোষ্ঠিরা। এরপর বেলা এগারটার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তারা আশ্বস্ত হন। তবে পুলিশের উপস্থিতিতেই তাদের উপর হামলার শিকার হয়েছেন বলে দাবী করেন ভুক্তভোগী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিরা। এতে তাদের দিলিপ কুমার, সুশীল কুমার, রতœা রানী , সোহাগ, হৃদয় কুমার, আকাশ, নদু সিং, সুখি রানী, রিপন, মিনা, শান্ত সিং, সন্তোষ সিং, গজেন সিং, নয়ন সিং, অর্জুন সিং, কৃষ্ণ সিং, পরী সিং, সুকুমার সিং, সোহানা সিং, সহ কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়েছেন। গুরুতর আহতদের ১৫ জনকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অপরদিকে গ্রামবাসীর মধ্যে জসিম উদ্দিন সরকার, হায়দার আলী , মিলন সরকার, ফারুক হোসেন, আছাবুদ্দেীলা, টুটুল হোসেন, নুরুন্নবী সরকার সহ কমপক্ষে ২৫ জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জনকে শেরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও ২ জনকে বগুড়া মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানা যায়।
আহত নৃ-গোষ্টি জয়দেব কুমার জয়, অর্জুন সিং, প্রাণ কুমার সিং, রতন সিংসহ স্থানীয়দের অভিযোগ, জমিদখলে বাধা দিলে জোতদাররা তাদের উপর সসস্ত্র হামলা করেছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ নির্বশেষে কেউই রেহাই পায়নি। আমরা হামলার বিষয়টি আগেই বুঝতে পেরে চেয়ারম্যনের কাছে সহায়ত চেয়েছি। হামলার আগে পুলিশ আসলেও তারা নিরব ভূমিকায় থেকেছেন। আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার সময়েও পথে হামলা করা হয়েছে। এজন্য অনেকে গুরুতর জখম নিয়েও বাড়িতে চিকিৎসা নিয়েছেন।
আদিবাসী পরিষদ বগুড়া জেলা কমিটির সভাপতি সন্তোষ সিং অভিযোগ করে বলেন, গত তিন-চারদিন ধরে আমাদের মালিকানাধীন দখলীয় জমি হাফিজুর রহমান, সোলায়মান আলী ও স্বপন মিয়া শতাধিক ভাড়াটে লোক দিয়ে দখলে নিতে শুরু করেছেন। সেসব জমিতে পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ করে চারা লাগাচ্ছিলেন তারা। নিষেধ করায় আমাদের ২০ থেকে ৩০ জনকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছেন। সেই সঙ্গে স্থানীয় বাজারে আদিবাসীদের দোকান ঘরগুলো ভাঙচুর করেছে। এমনকী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসার সময়ও আমাদের ওপর হামলা চালানো হয়। এছাড়াও আমরা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছি না। উপরন্ত আজ পুলিশের উপস্থিতে আমাদে উপর হামলা করা হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছি।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সোলায়মান আলী অভিযোগ করে বলেন, আদিবাসী নামে কতিপয় উশৃঙ্খল মাদক কারবারি ও ভূমিদস্যুদের অত্যাচারে আম্বইলসহ আশপাশের চার গ্রামের নিরীহ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এসব এলাকার ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি সরকারি খাস সম্পত্তি বলে নিজেরা জবরদখল শুরু করেছেন তারা। এরই ধারাবাহিকতায় আমার পনের বিঘা জমি দখলের পাঁয়তারা চালাচ্ছিলেন তারা। অথচ এসব জমি কেনার পর থেকেই দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করে আসছি আমি। এরমধ্যে চারবিঘা জমিতে বোরো চারা লাগানোর সময় কমল সিং ও সন্তোষ সিং তাদের লোকজন নিয়ে তীর-ধনুকসহ দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালান। সেই সঙ্গে বেধড়ক পিটিয়ে বিশ থেকে পঁচিশজনকে গুরুতর আহত করেন।
বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. জাহিদুল ইসলাম শিপলু বলেন, এখানে শেরপুর থেকে সংঘর্ষে আহত হয়ে ছয়জন এসেছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে তারা শঙ্কা মুক্ত।
শেরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আতাউর রহমান খোন্দকার বলেন, সংঘর্ষের খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে যাই এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনি। সেইসঙ্গে উভয়পক্ষকে শান্ত করে আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এছাড়া কোনোপক্ষই লিখিত অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে শেরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা সুলতানা বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। তবে বিবাদমান জমির কাগজপত্র নিয়ে দুইপক্ষকেই আলোচনায় বসার জন্য বলা হয়েছে। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।