সিলেটের বিআরটি অফিসের এডি রিয়াজুল ইসলাম ও আব্দুল বারী এখনো বহালতবিয়তে !
গত ৫ আগস্টের পর সিলেটের সবকটি সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি শুরু হলেও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সিলেট সার্কেলে কর্মরত মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল বারী ও তার সহযোগী এই দুর্নীতিবাজ চক্রের কিছুই হয়নি। ক্ষমতার অপব্যবহার আর ঘুষ বাণিজ্যে সিলেটেবাসীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছেন তারা। আব্দুল বারী ও তার স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অনুসন্ধান করলেই পাওয়া যাবে অর্ধশত কোটি টাকার দুর্নীতির প্রমাণ।
আওয়ামী সরকারের ক্ষমতার দাপটধারী আলোচিত বিআরটি সিলেটের এডি রিয়াজুল ইসলাম ও মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল বারী এখনো বহালতবিয়তে আছেন।
দুজনে মিলে বিআরটি অফিসে প্রায় ৬০ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন বলে এর আগে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এদের অপকর্মের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে যানবাহন মালিক-শ্রমিকরা অতিষ্ঠ হয়ে আন্দোলনও করেন। তাদের দুর্নীতি নিয়ে দৈনিক সকালের সময়ে বিগত সময়ে পরপর দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও নেয়া হয়নি কার্যকর কোনো ব্যবস্থা।
২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আব্দুল বারীর সিন্ডিকেট সদস্য তার পছন্দের মোটরযান পরিদর্শক রিয়াজুল ইসলামকে বিআরটিএ চাঁদপুর সার্কেল থেকে বিআরটিএ কুমিল্লা সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয় কর্তৃপক্ষ। আব্দুল বারী বিদায় নিয়ে চলে যান বিআরটিএ কুষ্টিয়া সার্কেলে। রিয়াজুল ইসলাম সহকারী পরিচালক দায়িত্ব (চ. দা.) পাওয়ার সময় সেখানে দুজনে সিন্ডিকেট গড়ে কাজ করার সুবিধার্থে লেয়াজোঁ কের যেখানে দায়িত্ব পাবে সেখানে আব্দুল বারী মোটরযান পরিদর্শকের দায়িত্ব নেবেন এমন পরিকল্পনা তৈরি করেন এই দুই কর্মকর্তা। পরিকল্পনার ফাঁদে পা দিয়ে নীতিমালা লঙ্ঘন করে বিআরটিএ মোটরযান পরিদর্শক রিয়াজুল ইসলামকে বিআরটিএ কুমিল্লা সার্কেল থেকে সিলেট সার্কেলে বদলি করে বিআরটিএ প্রশাসন বিভাগ।
সিলেট সার্কেলে সেই সময়ে সহকারী পরিচালকের (ইঞ্জি.) দায়িত্ব পালন করতেন বর্তমান বিআরটিএ ঢাকা মেট্রো-২ সার্কেলের উপ-পরিচালক সানাউল হক। বিআরটিএ সিলেট সার্কেলের নানান অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি গত বছরের ৯ এপ্রিল সিলেটে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়। তবে সকলের অনুরোধে পরিবহন মালিকরা ধর্মঘট স্থগিত করলেও শ্রমিক আন্দোলনের চাপে একই মাসের ১২ তারিখ বিআরটিএর সদর কার্যালয়ের এক আদেশে সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার সানাউল হককে সিলেট সার্কেল থেকে মাগুরা সার্কেলে বদলি করা হয়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রিয়াজুল ইসলাম দায়িত্ব পাওয়ার লিস্টে থাকায় উপর মহলে তদবির করে গত বছরের ১২ এপ্রিল বিআরটিএ সিলেট ও সুনামগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পরচিালক (ইঞ্জি.) চলতি দায়িত্ব হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে নেন। এরই মধ্যে ঘুষ বাণিজ্যের সাম্রাজ্য গড়তে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল বারীকে বিআরটিএ সিলেট সার্কেলে বদলি হতে পরামর্শ দেন রিয়াজুল ইসলাম। পরামর্শ পেয়ে ক্ষমতার জোরে বিআরটিএর প্রশাসন বিভাগকে ম্যানেজ করে ২০ মাসের মাথায় ২০২২ সালের ১৮ মে বিআরটিএ কুষ্টিয়া সার্কেল থেকে বিআরটিএ সিলেট সার্কেলে বদলি হয়ে আসেন আব্দুল বারী।
বিআরটিএ প্রশাসন বিভাগ কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়ে নীতিমালার কথা মুখে বললেও প্রভাবশালী ও ঘুষ দুর্নীতিতে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ দালাল নিয়ন্ত্রক এই আব্দুল বারীদের বিষয়ে নীতিমালা মানেন না বলে মাঠপর্যায়ের স্বচ্ছ কর্মকর্তাদের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। তবে এসব বিষয়ে নজর দেয়ার জন্য বিআরটিএ প্রশাসন বিভাগের কেউ নেই বলে জানান বিআরটিএর ডজনখানেক মোটরযান পরিদর্শক।
তাদের বক্তব্য, আব্দুল বারীর কুমিল্লা সার্কেল থেকে কুষ্টিয়া সার্কেল এবং সর্বশেষ কুষ্টিয়া থেকে সিলেট সার্কেলে বদলিতে কোনো নীতিমালা মানা হয়নি। সিলেট সার্কেলে বদলি হয়ে দালাল নিয়ন্ত্রণ, ঘুষ বাণিজ্যসহ সব ধরনের অপকর্ম নিজ হাতে তুলে নেন আব্দুল বারী। সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) রিয়াজুল ইসলাম, মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল বারী, মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট সাদিকুর রহমান ও অফিস সহকারী সাইফুল ইসলাম মিলে সিলেট বিআরটিএতে তৈরি করেন ঘুষ বাণিজ্য ও অনিয়ম-দুর্নীতির আঁতুড়ঘর। তারই ধারাবাহিকতায় পাঁচ হাজার সিএনজি অটোরিকসা নিবন্ধনের নামে ৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা করেন এই ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী।
এদিকে গত ২২ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব বিষয়ে সংবাদ প্রচারিত হলে ২ ডিসেম্বর বিভাগীয় তদন্তের জন্য আদেশ দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারেননি তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এরপর এই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলা সিএনজিচালিত অটোরিকসা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. জাকারিয়া আহমদ ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধ এবং রিয়াজুল ও আব্দুল বারীকে অপসারণের জন্য ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিলেও এখনো বহাল রয়েছেন তারা। তবে তাদের এসব অপকর্ম চাপা দিতে কতিপয় সাংবাদিককে বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন এসব কর্মকর্তা।
যেভাবে হয় অবৈধ লেনদেন : যে কোনো ধরনের কাজের জন্য বিআরটিএতে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। এরপর পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ হয় এবং তারপর ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে হয়। কিন্তু এর আগের দিন কাগজপত্র নিয়ে বিআরটিএ অফিসে গিয়ে একটি মার্ক করা লাগে। এই মার্ক করতে মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এসএম সামিউল ইসলামের মাধ্যমে ঘুষের টাকা নেয়া হয়। এরপর দালালদের মাধ্যমে কাগজপত্রে ঘুষের মার্ক করানো লাগে। কাগজে মার্ক করা হয় ১, ২, ৩ করে। মানে এক হলে ১ হাজার টাকা, দুই হলে ২ হাজার টাকা। এক-পাঁচ দিলে ১ হাজার ৫০০ টাকা। গাড়িতে কোনো সমস্যা থাকলে সেটিও দালালের মাধ্যমে অবজেকশন দেয়ানো হয় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার বিনিময়ে। লাইসেন্সপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার টাকা। অস্থায়ী ফিঙ্গারের রোলের জন্য দিতে হয় ১ হাজার টাকা। সরকারি ফির বাইরে ফিটনেস পরীক্ষায় প্রতি সিএনজি বাবদ ঘুষ রাখা হয় ২ হাজার টাকা, বড় গাড়ি ৩ হাজার আর ট্রাক সাড়ে ৪ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে জানতে বিআরটিএ সিলেট সার্কেলের সহকারী পরিচালক (এডি) রিয়াজুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। অন্যদিকে মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল বারীর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। দাপ্তরিক কাজের খুব একটা চাপ না থাকায় সিলেটে কোনো পরিচালক না থাকায় রাজত্ব কায়েম করছেন রিয়াজুল। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিআরটিএ পরিচালক মাসুদ আলম সিলেটে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন।
এ ব্যাপারে বিআরটিএ চেয়ারম্যান গৌতম চন্দ্র পাল প্রতিবেদককে মুঠোফোনে জানান, তিনি গত জুলাই মাসে দায়িত্ব নিয়েছেন। এসব বিষয়ে তিনি অবগত নন। খোঁজ নিয়ে গুরুত্বসহকারে বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন।