ঈদুল আজহা সমানে রেখে সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে গরু মহিষ চোরাচালান চক্র সক্রিয়। রাতের অন্ধকারে ভারত সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে চোরাই গরুর চালান দেশে প্রবেশ করছে। আর এসব গরু মহিষ স্থানীয় কতিপয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সহযোগিতায় দেশী পশু হিসেবে প্রকাশ্যে হাটবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রান্তিক কৃষক, খামারি ও ব্যবসায়ীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) চোরাচালান রোধে চেষ্টা চালালেও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় চোরাকারবারিরা কার্যক্রম চালিয়েই যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, সিলেটের চারটি উপজেলার সীমান্ত দিয়ে অবাধে প্রবেশ করছে ভারতীয় গরু মহিষসহ চোরাচালানী। জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রায় ১০টি এলাকা দিয়ে ভারতীয় গরু-মহিষ প্রবেশ করছে।
আর বিছনাকান্দি, দমদমিয়া, সোনারহাট, পান্ডমাই, প্রতাপপুর, হাজিপুর, লামাপুঞ্জি, নলজুরি। জেলা ডিবি ও থানা পুলিশের লাইনম্যান হাদারপার গ্রামের গোলাম হোসেন, হাদারপারের সেবুল, বিছনাকান্দির আব্দুল মালিক, হাদারপারের ফরিদুল, রস্তুমপুর ইউপির হেলাল উদ্দিন, তোযয়াকুলের লোকমান চেয়ারম্যান। প্রতিটি গরু থেকে ২ হাজার আর মহিষ থেকে ৩ হাজার করে টাকা আদায় করেন। উপজেলার প্রতাপপুর, হাজিপুর, লামাপু-ঞ্জি এলাকার পুলিশ-বিজিবির লাইনম্যান হাদারপারের আখলাকুল আম্বিয়া হোসেন।
এসব গরু মহিষ উপজেলার হাদারপার বাজারে আসলে দেওয়া হয় বৈধতা। যাকে বাজারের ভাষায় রশিদ বই বলে।
গোয়াইনঘাট সীমান্তে দিয়ে আসা গরু গুলো, সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার রাধানগর বাজার, পিরের বাজার, তোয়াকুল বাজারে বিক্রি হয়। দেশের বাজারে ভারতীয় গরুকে দেশীয় গরু হিসাবে রশিদ দেওয়া হয়।
গোয়াইনঘাট থানার পুলিশ এসআই রাকিব, এসআই আল আমি ও এএসআই তানবির সরাসরি জড়িত।
বিজিবির লাইনম্যান ছৈলাখেলের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুশ শহিদ, ইবু, হযরত আলী, নুরু মেম্বার, লাখেরপারের শাহ আলম, গুচ্ছগ্রমের লামাটিম গ্রামের মহর আলীর ছেলে ডালিম।
তামাবিলের বিজিবির লাইনম্যান নলজুরির বাবলা সোনাাটিলার করিম, লনজুরির সাদ্দাম, নাঈম। এছাড়া, উপজেলার প্রায় ১০ টি পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ভারতীয় গরু-মহিষ প্রবেশ করে।
এরমধ্যে খাশির হাওর, মোকামপুঞ্জি, শ্রিপুর চা বাগান এলাকা। ডিবির হাওর, গিলারতল, গোয়াবাড়ি, কমলা বাড়ি, লালাখাল, নলজুরী, মোকামবাড়ী, আলুবাগান, শ্রীপুর, মোকামপুঞ্জি, মিলাটিলা, ছাগল খাউরী, কাঁঠালবাড়ী, আদর্শগ্রাম, কেন্দ্রী হাওর, ডিবির হাওর, ঘিলাতৈল, ফুলবাড়ী, টিপরাখলা, কমলাবাড়ী, করিমটিলা, গুয়াবাড়ী, বাইরাখেল, জালিয়াখলা, লালাখাল, জঙ্গীবিল, বালিদাঁড়া, বাঘছড়া, সিঙ্গারীপাড়, সুরাইঘাট। এ উপজেলায় বিজিবির লাইনম্যান উপজেলার গিলারতল গ্রামের আব্দুল করিম উরফে ব্যান্ডিজ করিম, তার ভাগ্না রুবেল, ইসমাইল। পুলিশের লাইনম্যান দেলোয়ার হোসেন। এই উপজেলা দিয়ে যে সকল গরু-মহিষ আসে, তা জৈন্তাপুর বাজার, দরবস্তবাজার, চিকনাগুল বাজারে নিয়ে এসে দেশীয় রশিদ দেওয়া হয়।
তাছাড়া, জৈন্তাপুরের প্রায় ৭ টি পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ভারতীয় গরু-মহিষ। এলাকাগুলো হলো কানাইঘাটের মুলাগুল, ডনা, সোনারখেল, বালুকমারা, কারাবাল্লা ও জকিগঞ্জের আটগ্রমামসহ কয়েকটি সীমান্ত এলাকা দিয়ে গরু চোরাচালান বেড়ে গেছে। প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার গরু সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে। একটি সিন্ডিকেট সরাসরি ভারত থেকে এসব গরু কৌশলে দেশে নিয়ে আসছে। রাতভর চলে গরু চোরাচালান।
অভিযোগে জানা গেছে, পুলিশ, বিজিবি এবং বিভিন্ন মহল গরু সিন্ডিকেট থেকে নিয়মিত টাকা পায়। গরুর আকার অনুযায়ী ৩০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত পৃথকভাবে দেওয়া হয়। কানাইঘাটের মুলাগুল, ডনা, সোনারখেল, বালুকমারা, কারাবাল্লা ও জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখাল ও জকিগঞ্জের আটগ্রামসহ কয়েকটি সীমান্ত এলাকা দিয়ে গরু চোরাচালান বেড়ে গেছে।
পুলিশ, বিজিবি কথিত সংবাদ কর্মীসহ বিভিন্ন মহল গরু সিন্ডিকেট থেকে নিয়মিত টাকা পায়। গরুর আকার অনুযায়ী ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কোম্পানীগঞ্জের উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের বরম সিদ্দিপুর, মাঝেরগাঁও, উৎমা, লামাগ্রাম ও তুরং এলাকা নারায়ণপুর, ছিকাডহর ও ছনবাড়ি, বিছনাকান্দি বাজার থেকে উত্তর রণিখাই হয়ে কোম্পানীগঞ্জ শহরেও আসে। এসব গরু ভোলাগঞ্জ, পারুয়া, শারপিন, বউবাজার, টুকেরবাজার ও খাগাইল বাজারে আসে। বরম সিদ্দি-পুর সীমান্তে লাইনম্যান হিসেবে হেলাল আহমদ, তৈয়ব আলীসহ কয়েকজন চাঁদা আদায় করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গরু মহিষসহ চোরাই পণ্য থেকে লাইনম্যানখ্যাত লোকজন পুলিশ, ডিবি পুলিশ ও বিজিবির নামে চাঁদা আদায় করে। তারা পুলিশের নামে গরুপ্রতি ১ থেকে ৩ হাজার টাকা, বিজিবির নামে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা, প্রতিটি মহিষের জন্য তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা, প্রতি বস্তা চিনি কিংবা পেঁয়াজ থেকে পুলিশের নামে ১৫০ টাকা, বিজিবির নামে ১০০ টাকা আদায় করা হয়।
একইভাবে কাপড়ের কিট বা কার্টনপ্রতি ৩ থেকে ৫ হাজার, মাদকের কার্টনে ৪ থেকে ৬ হাজার, মোটরসাইকেলে ১০-১২ হাজার, প্রসাধনসামগ্রীর কার্টন থেকে দেড় হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। আর ২০০ থেকে ৩০০ ট্রাক পণ্য ও শত শত গরু-মহিষের ওপর প্রতিদিন অর্ধকোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়ে থাকে।
এসব চোরাচালানে লাইনম্যান নামের বিশেষ চাঁদাবাজ বাহিনী গড়ে উঠেছে। বেশির ভাগ চোরাচালান হয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।
জৈন্তাপুরের হরিপুর বাজারের শতাধিক ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করেন চোরাচালান। সীমান্ত এলাকার আরও ১০০ জনের মতো ব্যবসায়ী রয়েছে।
জড়িত রয়েছে সিলেট নগরীর কিছু লোকও ।
পণ্যের বিপরীতে তারা হুন্ডিসহ বিভিন্নভাবে টাকা পরিশোধ করে থাকেন। এসব ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন চোরাচালানে। ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ রয়েছে। সীমান্ত পার করায় নিয়োজিত থাকেন একশ্রেণির শ্রমিক। তারা পণ্য বহনের জন্য রাস্তার দূরত্ব বুঝে পারিশ্রমিক পান। উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীদের কখনও ফাঁকি দিয়ে, কখনওবা ম্যানেজ করে পণ্য আনা হয়। ‘লাইনম্যান’খ্যাত লোকজন টাকা তোলে।
লাইন নিয়ন্ত্রণ করেন প্রভাবশালীরা। তাদের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। সীমান্ত পার করার পর পণ্য এলাকার বাড়ি কিংবা দোকানসহ নিরাপদ স্থানে মজুত করা হয়। আর সিলেটের চারটি থানার ওসিরা সরাসরি চোরাচালানের সাথে জড়িত। তারা প্রতিমাসে নতুন নতুন লোককে সীমান্ত ঘাট ইজারা দিয়ে মাসোহারা আদায় করেন।
সীমান্তে গরু পাচার নিয়ে পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি মিডিয়া এর সেল ফোন বার বার কল করা হলেও তিনি তার ফোনটি রিসিভ করেননি। পরে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজিকে ফোন করা হলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এরপর অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আজিজুল ইসলাম সকালের সময়কে জানান, বিষয়টি জানলাম, আগামিকাল ডিআইজি স্যার আসলে বিষয়টি আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর বিজিবি-৪৮ ব্যাটালিয়ান কমান্ডার এর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
সূত্র-সকালের সময়