ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে সিলেটে সুরমা নদীর চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ফুঁসে উঠেছে কুশিয়ারা।ফলে কুশিয়ারা নদীর তীরের বাসিন্দাদের বন্যায় বেড়েছে ভোগান্তি ।
কুশিয়ারার চারটি এবং সুরমা নদীর দুটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী উপজেলাগুলোর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর ছাড়াও সুরমা ও লোভাছড়ার তীরবর্তী কানাইঘাট উপজেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানি ওঠানামা করায় ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা বেড়েছে।
বিশেষ করে সুরমা-কুশিয়ারার উৎসমুখ জকিগঞ্জ উপজেলার কোথাও ডাইক ভেঙে পানি লোকালয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত করেছে। একই ভাবে কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমার একাংশ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বন্যা বিস্তৃত হয়েছে। বেড়েছে বানবাসী মানুষের সংখ্যা। তবে নগরে জলাবদ্ধতা দুই-এক জায়গা ছাড়া দৃশ্যমান হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের দেওয়া তথ্য মতে, বুধবার (০৩ জুলাই) বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি সিলেটের কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮১ সেন্টিমিটার ওপরে অবস্থান করছে। তবে সর্বাধিক পানি বেড়েছে তিন নদীর মোহনা খ্যাত কুশিয়ারা নদীর জকিগঞ্জ উপজেলার অমলশীদ পয়েন্টে। বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিপৎসীমার ১৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহমান ছিল। ওই স্থানে প্রতি ঘণ্টায় পানি ২/৩ সেন্টিমিটার করে বাড়ছে, জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিপৎসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারার পানি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিয়ানীবাজারের শেওলা পয়েন্টে ৪৩ সেন্টিমিটার, বালাগঞ্জ শেরপুর পয়েন্টে ১৯ সেন্টিমিটার এবং সিলেট পয়েন্টে সুরমার পানি বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গত ২৩ জুন থেকে কুশিয়ারার পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বৃদ্ধি পেয়ে ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ কয়দিন কুশিয়ারার পানি ফেঞ্চুগঞ্জ ব্যতীত অন্যান্য পয়েন্টে বিপৎসীমার নিচে নেমে যায়। কিন্তু ফেঞ্চুগঞ্জে ধীর গতিতে নামায় বিপৎসীমার ৮১ সেন্টিমিটার ওপরে অবস্থান করছিল পানি। ফের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এসব উপজেলার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুশিয়ারার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিয়ানীবাজারের দুবাগ, গজুকাটা, আলীরগাও, চারখাই, চরিয়া, মুড়িয়া, গোবিন্দশ্রী, মাতিউরা, টিকরপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। একই ভাবে গোলাপগঞ্জ উপজেলার আছিরগঞ্জ, বাগলা, ভাদেশ্বর, মোকামবাজার, ডেপটিবাজার, শরীফগঞ্জ, পনাইরচক, পানিআগা, মীরগঞ্জ, কদুপুর, খাটকাই গ্রাম, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদর, হাসপাতাল ও বাজার সড়ক, ঘিলাছড়ার বাদেদেউলী, যুদিষ্টিপুর, আশিঘর, ছত্তিশ, পিঠাইটিকর, মোমিনপুর, কটালপুর, মল্লিকপুর, কুতুবপুর, তীলপাড়া, গঙ্গাপুর, গয়াসী, মুসলিমাবাদ, গৌরীপুরসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন।
এছাড়া ওসমানীনগরের জালালপুর, সুলতামপুর, পাড়জোর, গহরপুর এবং বালাগঞ্জ উপজেলার থানাবাজার, বোয়ালজোর, পারজুড়, ফতুরখাড়া, আদিপুর, তালতলাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলায় ১৩টি উপজেলায় ৯১টি ইউনিয়নের ১১৬০টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন ৬ লাখ ৪৯ হাজার ৩৭৮ জন। ৬৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্রের ১৯৫টিতে আশ্রিত আছেন ৮ হাজার ৩৫১ জন।
জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফসানা তাসলিম বলেন, প্রথম ধাপের বন্যায় জকিগঞ্জের ৩/৪টি ডাইক ভেঙে যায়। আর এবার নদীর পানি বেড়ে গিয়ে ডাইকের ওপর দিয়ে লোকালয়ে ঢুকেছে। ফলে নতুন করে বেশকিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
তিনি বলেন, উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ৮৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে লাখের ওপর মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। উপজেলায় ৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩০টি পরিবার অবস্থান করছে।
কুশিয়ারার তীরবর্তী ভাটি এলাকা বালাগঞ্জ উপজেলায় ৬টি ইউনিয়নের ১৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মারিয়া হক। তিনি জানান, উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়ে ২১ হাজার ৩৫৫ জন বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন। ৩৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন ২ হাজার ৬৬ জন।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, বন্যা আক্রান্তদের মধ্যে সিলেট সদর এলাকায় ৮২০ জন, বিশ্বনাথে ৫ হাজার ৩৬০ জন, ওসমানীনগরে এক লাখ ৮২ হাজার, ফেঞ্চুগঞ্জে ১২ হাজার ৫৭৮ জন, দক্ষিণ সুরমায় ২০ হাজার ১০ জন, কোম্পানীগঞ্জে ৯৪ হাজার ৩৮৫ জন, জৈন্তাপুরে ৯ হাজার ২১০ জন, গোয়াইনঘাটে ৯৮ হাজার ৬০০, কানাইঘাটে ১৯ হাজার ৪২০, জকিগঞ্জে ৮৪ হাজার ৪৩২ জন, বিয়ানীবাজারে ৪৫ হাজার ৯০০ জন, গোলাপগঞ্জে ৪৩ হাজার ২০৭ জন বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত) সিলেটে ২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। বুধবার সকাল ৬টার পর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৭ দশমিক ৪ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।