মো: লোকমান হেকিম:: শরবত রোজাদারের ইফতারের অন্যতম পানীয়। রোজাদারের দেহের সারাদিনের ঘাটতি দ্রুত পূরণে শরবত বিশেষ ভূমিকা রাখে। সারাদিন অনাহারে থাকার ফলে শরীরে পানি ও গ্লুকোজের অভাব হয়। এজন্য এ সময় চিনি বা গুড় বা ফলের শরবত পান করা প্রয়োজন। এতে দেহে দ্রুত পানির ঘাটতি পূরণ করে শক্তি দেবে। শরবতে রয়েছে খাদ্যশক্তি, গ্লুকোজ, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ। শরবত তৃষ্ণা মেটায়, পেট ঠাণ্ডা রাখে, খাদ্যদ্রব্য হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। খাবার স্যালাইনের মতো দ্রুত শক্তি দেয়।
কোন শরবত স্বাস্থ্যসম্মত সেটাই প্রশ্ন। বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের যে রঙিন শরবত পাওয়া যায় তা মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। রঙিন শরবতে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে। বাজারের ফলের জুসে ফলের রস নেই। আছে ফ্লেভার ও রাসায়নিক পদার্থ। চিনি, গুড়, লেবু ও পানি দিয়ে তৈরি শরবতই সবচেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত। অনেকেরই প্রশ্ন চিনি ও গুড়ের মধ্যে কোনটি ভালো। পুষ্টিবিদ ও ভেষজবিদদের মতে, চিনির চেয়ে গুড় বেশি পুষ্টি ও ভেষজসমৃদ্ধ। আখের গুড় চিনির চেয়ে বেশি হজম হয়। গুড়ে আখের রসের সব খনিজ ও ক্ষারক পদার্থ সুরক্ষিত থাকে। তবে গুড়ে প্রচুর ময়লা থাকে। এই ময়লা পরিশোধন করতে পারলে গুড়ই উত্তম হতো।
চিনি তৈরির সময় কিছু রাসায়নিক পদার্থ দেয়া হয় যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আয়ূুর্বেদ মতে, গুড় রক্তস্বল্পতা, জন্ডিস, পিত্তনাশ ও কোনো স্থানে ফুলে ওঠা দূর করে। গুড়ের শরবত কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। গুড়ে চিনির চেয়ে ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ফসফরাস বেশি থাকে। অনেকেই আখের রস পুষ্টিসমৃদ্ধ মনে করে ইফতারে শরবত হিসেবে পান করেন। আখের রসের চেয়ে গুড় ও চিনিতে ১০ গুণ বেশি খাদ্যশক্তি, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস থাকে।
এছাড়াও আখের রসে ময়লা থাকার সম্ভাবনা বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম আখের গুড়, চিনি ও আখের রসে পুষ্টি থাকে যথাক্রমে খাদ্যশক্তি ৩৮৩, ৩৯৪ ও ৩৯ কিলোক্যালরি; শর্করা ৯.৫, ৯.৮ ও ৯.১ গ্রাম; ক্যালসিয়াম ৮০, ২৮ ও ১০ মিলিগ্রাম; ফসফরাস ৪০, ৪ ও ১০ মিলিগ্রাম এবং আয়রন ১১.৪, ০.১ ও ১.১ মিলিগ্রাম। ধুলাবালু ও ময়লা পরিষ্কার করে তৈরি করতে পারলে আখের গুড়ের শরবতই স্বাস্থ্যসম্মত। ইফতারি করার এক ঘণ্টা পর প্রচুর পানি পান করা সবচেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত। তবে নিজেদের তৈরি টাটকা ফলের রসের শরবত উত্তম।
সুস্থতার জন্য পানি : জীবন ধারণের জন্য বায়ুর পরেই জরুরি হলো পানি। পানি মহান স্রষ্টার এক মহানিয়ামত। পানি ছাড়া জীবন অচল। তাই বলা হয়-‘পানির অপর নাম জীবন।’ এ কথাটি বায়ুর বেলায় বেশি খাঁটি নয় কী? পানি ছাড়া পাঁচ দিন বাঁচা সম্ভব কিন্তু বায়ু ছাড়া পাঁচ মিনিটের বেশি বাঁচা দায়। মুখ বন্ধ করে নাকটা একটু চেপে ধরুন-এর সত্যতা সহজেই বুঝতে পারবেন। আর আপনা থেকেই উচ্চারিত হবে ‘বায়ুর অপর নাম জীবন।
তবে পানি ছাড়া সাময়িক বেঁচে থাকলেও পানির অভাবে একসময় মরণ নির্ঘাত। এ কারণে প্রতিটি জীবের জন্যই চাই বিশুদ্ধ পানি। তাই জীবন বাঁচানো ও সুস্থতার জন্য অক্সিজেনের পরেই পানির প্রয়োজন। মানুষের দৈহিক ওজনের শতকরা ৭০ ভাগই পানি। মাংসপেশীতে ৫০%, চর্মে এবং কোষ বহিঃস্থ কলায় ২০% এবং রক্তে প্রায় ৭% পানি থাকে। পুরুষের দৈহিক ওজনের ৬০% এবং মহিলাদের ৫০% পানি দ্বারা গঠিত।
দেহে পানির অভাবে সমস্যা : দেহে পানির অভাব হলে তৃষ্ণা পায়। সাথে সাথে তৃষ্ণা দূর করতে না পারলে বিভিন্ন রোগ ও দৈহিক সমস্যা হয়। দেহ থেকে ঘামসহ বিভিন্ন কারণে পানি বের হলে পানির ঘাটতি হয়। এতে খনিজ পদার্থ মূত্রের সাথে কিডনি ও মূত্রথলিতে জমা হয়ে পাথর হয়। দেহে পানির ঘাটতি হলে বারবার বমি, রক্তপাত, পাতলা মলত্যাগ হয়। দেহের জলীয় অংশের শতকরা ১০ ভাগ পানি বের হলে শারীরিক অবস্থা বিপজ্জনক হয়। তখন রক্ত সংবহনে ব্যাঘাত ঘটে, খাদ্য হজম হয় না, পুষ্টিশোষিত হয় না, তাপ বাড়ে, কিডনি বিকল হয়, গ্যাস্ট্রিক হয়, দেহ নিস্তেজ হয়। শরীর দুর্বল হয়, ত্বক খসখসে হয়, কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। প্রস্রাবে জ্বালাপোড়াসহ বিভিন্ন সমস্যা হয়। পানির বেশি ঘাটতি হলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। কিডনি বিকল হয়ে মাংস পেশী ফুলে উঠে।
দেহে পানির কাজ : দৈনিক পূর্ণবয়স্ক পুরুষের তিন লিটার, মহিলাদের ২.৫ লিটার, যুবক-যুবতীদের তিন লিটার, শিশুদের ১.৫ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। প্রতিদিন স্বাভাবিক কারণে একজন পূর্ণবয়স্ক দেহ থেকে ২.৫ লিটার পানি বের হয়। জাপানে চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণের মানব দেহে পানির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এক গবেষণা রিপোর্টে লেখা হয়েছে যে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দৈনিক ৫ লিটার পানি পান করলে তার জীবনে ৫০০ রোগ হবে না। বিশেষ করে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে পানি পান করার গুরুত্ব দিয়েছে ঐ রিপোর্টে। মানবদেহের জৈবিক, রাসায়নিক ভৌতিক ও বিপাকীয় কাজে পানির বিকল্প নেই। খাদ্য গ্রহণের পরপরই পানি পান না করে ৩০ মিনিট পরে অল্প পানি পান করলে খাদ্য হজম ভাল হয় এবং ২-৩ ঘণ্টা পরে বেশি পরিমাণ পানি পান করলে পরিপাককৃত পুষ্টি রক্তে শোষিত হয়। খাদ্য খাওয়ার সময় পানি পান করলে পাচকরস দুর্বল হয়। ফলে খাদ্য হজমে ব্যাঘাত ঘটে। চর্মরোগ বা ত্বকজনিত সমস্যা দূর করতে অর্থাৎ ত্বক মসৃণ ও আকর্ষণীয় করতে পানি পান করা প্রয়োজন। যৌনশক্তি অক্ষুণ্ন রাখা ও বৃদ্ধি করতে নিয়মিত প্রচুর পানি পান করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সহবাসের পর পানি পান করলে দ্রুত যৌনশক্তি ফিরে আসে।