ঢাকাশনিবার , ২১ ডিসেম্বর ২০২৪
আজকের সর্বশেষ সবখবর

১৫ বছরে ভা র তে র সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে,অ ধি কাং শ চু ক্তি তে সুবিধা পেয়েছে দিল্লি

rising sylhet
rising sylhet
ডিসেম্বর ২১, ২০২৪ ৬:৩৯ অপরাহ্ণ
Link Copied!

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম । কিন্তু তার দশ দিন আগেই ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারত। পরের বছর ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্ব ও নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

স্বৈরশাসনের ১৫ বছরে ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে, তার অধিকাংশ চুক্তিতে সুবিধা পেয়েছে দিল্লি। ভারত সরকারও বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মূল্যায়ন না করে একতরফাভাবে আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দিয়ে গেছে।

তবে, বন্ধুত্ব চুক্তি হলেও ভারত শুরু থেকেই বাংলাদেশে তার আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রতি ভারতের ছিল অগাধ বিশ্বাস। হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে সব ধরনের সুবিধা হাসিল করেছে মোদি সরকার।

বাংলাদেশের নয়, ভারত সব সময় নিজেদের স্বার্থই দেখেছে—এমন বিশ্বাস বাংলাদেশের মানুষের মনে শক্তভাবে জায়গা করে নিয়েছে। ‘ভারতকে যা দিয়েছি সেটি তারা সারা জীবন মনে রাখবে’ শেখ হাসিনার এই উক্তিটিই তা প্রমাণ করে। কিন্তু জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতন হজম করতে পারেনি ভারত। সেই থেকেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ফুঁসতে থাকা উত্তেজনা সম্প্রতি উগড়ে পড়েছে।

ভারত ট্রানজিট নিয়ে আ.লীগের ভাঁওতাবাজি–২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বাংলাদেশে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। সে সময়ের স্বৈরশাসকের মন্ত্রীরা বলেছিলেন ভারতকে ট্রানজিট দিলে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, দুবাইয়ের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো হয়ে উঠবে। বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ মানুষ ট্রানজিটের বিপক্ষে ছিল। কিন্তু জনগণের প্রতিবাদ ভ্রুক্ষেপ করেনি শেখ হাসিনা। পরের বছরেই বিনা শুল্কে ভারত ও বাংলাদেশ প্রথম নৌ-ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করে।

এরপর ভারতকে আরও চারটি নদীপথ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, পর্যায়ক্রমে ভারতকে বাংলাদেশের সড়ক ও রেল ট্রানজিটও দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।

চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি–ট্রানজিট দেওয়ার পর ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধাও দেয় স্বৈরাচার সরকার। বাংলাদেশের এ দুটি বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারত বহু বছর ধরে চেষ্টা করে আসছিল। এ চুক্তির ফলে, বাংলাদেশের বন্দর দুটি ব্যবহার করে ভারত নিজ দেশে পণ্য পরিবহন করতে পারবে।

হাসিনার আমলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী যত চুক্তি–স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে ভারতের সঙ্গে অন্তত ২০টি চুক্তি ও ৬৬টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের বেশির ভাগই বাংলাদেশের স্বার্থের তোয়াক্কা করা হয়নি। একতরফাভাবে ভারতকে সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।

মোদির বন্ধু আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি —চাহিদার তুলনায় দেশে উৎপাদন ক্ষমতা বেশি হওয়ার পরও ২০১৭ সালে ভারতের আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। মোদির ঘনিষ্ঠ বন্ধু গৌতম আদানি। তিনি আদানি পাওয়ারের মালিক। দেশের স্বার্থে নয়, আদানির স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই এই চুক্তি করে হাসিনা সরকার। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন বারবার দাবি করে এলেও এ চুক্তিটি প্রকাশ করেনি আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর আদানির চুক্তিতে নানা অনিয়ম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে করমুক্ত আমদানি নীতি, কয়লার বাড়তি দর, বিলম্বে বিল পরিশোধে অতিরিক্ত সুদ আরোপের জটিলতা রয়েছে। এমনকি যে রুট দিয়ে আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসছে তা কোনো শুল্ক স্টেশনই নয়।

এ ছাড়া আলোচিত চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বার্বভৌমত্বকে হুমকিতে রেখে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি, ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়চুক্তি, ভারতের সঙ্গে ‘গোলামি’র রেল চুক্তি, ভারতের স্বার্থ রক্ষায় রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অনেকে চুক্তি করা হয়েছিল।

চুক্তি ও সমঝোতা ছাড়াও বাংলাদেশে ভারতের কয়েক লাখ মানুষকে চাকরি দেওয়া, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর দায়িত্ব ভারতকে দেওয়া, বাংলাদেশের আইটি ক্ষাত ভারতীয়দের দখলে দেওয়া, চীনকে পাশ কাটিয়ে ভারতকে তিস্তা প্রকল্প দেওয়ার পরিকল্পনা, ভারতীয় টিভি চ্যানেলের অবাধ সম্প্রচার এবং বাংলাদেশকে ভারতের জন্য উম্মুক্ত বাজারের সুবিধাও দেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার পেছনে ভারতের ভূমিকা–বাংলাদেশে নির্বাচন এলেই ভারতের প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য ‘ভূমিকা’ নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়ে থাকে। বিশেষ করে ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা নিয়ে ব্যপক আলোচনা রয়েছে।

২০০১ সালে নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার পরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে সংবিধানে একটি বড় সংশোধনী আনে বিএনপি সরকার। এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে আওয়ামী লীগ। সংঘাতময় এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। এরপর ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলেও কার্যত সেটি পরিচালনা করেছে সেনাবাহিনী। অভিযোগ ওঠে, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতির বাইরে রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ভারতের হস্তক্ষেপে সেটির সফলতা না পেয়ে অনেক আলোচনা, সংলাপ ও কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি বিএনপি। দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলা হয়।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি নিজের আত্মজীবনীতে দাবি করেছেন, খালেদা ও শেখ হাসিনাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তিনি নিজে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভারত চায়নি বিএনপি ক্ষমতায় আসুক। তাইতো আওয়ামী সরকারের বিজেয়ের পরদিন শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল ভারত।

২০১৮ সালের নির্বাচনে আগে থেকেই ভারত প্রকাশ্যে দূরত্ব বজায় রেখেছিল। কারণ, নির্বাচনে বিএনপি অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ভারতের অত মাথা ঘামানোর প্রয়োজন করেনি, এমনটাই স্বীকারও করেছিলেন তৎকালীন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার।

বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করলেও নির্বাচনে ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন শেখ হাসিনার দিকেই ছিল, তা রাজনৈতিক অঙ্গনে গোপন ছিল না।

বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগের রাতেই ভোট হয়ে যাওয়ার অভিযোগ করা হয়। সেই কারচুপির কিছু ভিডিও প্রকাশও হয়। পরে নির্বাচন বয়কট করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ায় বিএনপি। অথচ, নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে বিন্দুমাত্রও সমালোচনা করা হয়নি। শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের সমর্থন যে দলমতনির্বিশেষে—সেটাই আরও একবার প্রমাণিত হয়।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি বাক বদল হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, বাংলাদেশের সাধারন নির্বাচনের ইতিহাসে ২০০৮ সালের নির্বাচনটি ছিল সর্বশেষ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার না দেওয়ায় ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির পাশাপাশি জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে, এ নির্বাচনে ভারতের তথাকথিত ‘হস্তক্ষেপ’ সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। নির্বাচনের ঠিক এক মাস আগে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য বাংলাদেশে আসেন।

ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে তখন বলা হয়েছিল, জাতীয় পার্টিকে চাপ দিয়ে নির্বাচনে নিয়ে আসতে এবং নির্বাচনকে একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ চেহারা দিতেই সুজাতা সিং এরশাদের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা সফর করেছিলেন। হয়েছিলও তাই, শেষ পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান থেকে সরে নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি এবং বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে।

শুধু তাই নয়, ২০২৪ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে এবারের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে ভারত।

বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, ভারতের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতায় প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করেও শেখ হাসিনার সরকার টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ধেরে রেখেছিল। এ সময়ে হাসিনা সরকারের দুর্নীতি, হত্যাসহ সব অন্যায় ভারত খোলামেলা সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ভারত মনে করে, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতা পেলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায় ফেরার পথ সুগম হবে। তাই তারা চায়নি বাংলাদেশে আওয়াম লীগ ছাড়া অন্য কেই ক্ষমতায় আসুক। অথচ, মুসলিম দেশে ইসলাম চর্চাটা স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য চাওয়াগুলো যেমন সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা, তিস্তাসহ ৫৪টি নদীর পানিবণ্টন চুক্তি ও ন্যায্য হিস্যা দেওয়া, এসব বিষয় আওয়ামী লীগের আমলে অমীমাংসিত থেকেছে।

বাংলাদেশের মানুষের ভারতবিদ্বেষ—বাংলাদেশি মানুষের মনে ভারতবিদ্বেষ একদিনে তৈরি হয়নি। ভারতের আগ্রাসন ও আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টার কারণে মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করা বিজেপি যখন ভারতে নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং সেখানে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর নির্যাতন হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতাও প্রভাবিত হয়।

শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যখনই প্রশ্ন উঠছে ভারত সরকার তাকে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে এড়িয়ে যেত। স্বৈরাচারের প্রতি এই অন্ধ সমর্থন বাংলাদেশের মানুষের মনকে তিতিবিরক্ত করে তুলেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় অভিযোগ করেছে, ভারত বাংলাদেশের জনগণের চাওয়াকে গুরুত্ব না দিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একপাক্ষিক সম্পর্ক মেইনটেইন করছে।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের আমলে সীমান্তে সংঘাত, আঞ্চলিক রাজনীতি ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ভারতের আধিপত্য ও ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের ক্রমাগত উত্থানের ফলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমা হয়েছে, যা ২০২১ সালে বাংলাদেশে মোদির সফরকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে আসে। সে সময় দেশের ইসলামিক দলগুলো ও সাধারণ মানুষ মোদির সফরের বিরোধিতা করে রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ জায়গায় আন্দোলন করে। শেখ হাসিনা তার সংগঠনের লোকদের দিয়ে হামলা চালিয়ে তা দমন করার চেষ্টা করে।

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার ও মৌলিক মানবাধিকারের বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে ইসলামি ধর্মীয় মৌলবাদ রুখে দেওয়া এবং চীনের প্রভাব খর্ব করার কথা বলে ভারত শেখ হাসিনার হয়ে আন্তর্জাতিকভাবে একধরনের ব্যবস্থাপকের ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল তখন ভারতের একতরফা আধিপত্যে ভাটা লাগতে থাকে। এই নিষেধাজ্ঞার আগ পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারকে তেমন কোনো আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের সম্মুখীন হতে হয়নি।

শেখ হাসিনার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অন্ধ সমর্থন ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষকে আরও সন্দিহান ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মানুষ ও গণতন্ত্র রক্ষায় এগিয়ে আসলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারতের অবস্থানে প্রকাশ্যে আসতে থাকে। শেষপর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক স্মরণকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

আ.লীগের পতন ও হাসিনার ভারতে আশ্রয়ে সম্পর্কে ভাঙন—ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একধরনের টানাপোড়েন আর উত্তেজনার মধ্যে যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের পতনকে ভারতের সরকার, দেশটির রাজনীতিবিদ, মিডিয়া কেউই মেনে নিতে পারছে না। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় সরকারসহ বিভিন্ন রাজনীতিকের নেতিবাচক মন্তব্য, ভারতীয় মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচার, চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তারে ক্ষোভ ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা।

রাজনীতি ও কূটনীতি–গত অগাস্ট থেকেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হলেও চিন্ময় দাসকে আটক ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার পর থেকে বিষয়টি আরও বেশি দানা বাঁধে। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার পেছনে ভারতীয় গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়াকে বেশি দায়ী করা হচ্ছে। এর ফলে ন্যায্যতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে একটি টেকসই ও আস্থাভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। বতর্মান পরিস্থিতি দুই ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে। প্রথমত, হাসিনা সরকার পতনের পর বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধী অবস্থান প্রকাশ্যে আসে। যার কারণে রাজনৈতিক দলের নেতারা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার বক্তব্য দিলে তাদের সমালোচনায় পড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে ভারত বিরোধী বক্তব্যে দেওয়া হলে সেসব বক্তব্য ইতিবাচক সমর্থনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

ভারতের অপপ্রচার ও সংখ্যালঘু ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি অবস্থান—হাসিনা সরকাররের পতনের পর থেকেই ভারতের মিডিয়াগুলোতে বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক খবর প্রকাশের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার, সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভুয়া ও মিথ্যে খবরও ছড়াতে দেখা গেছে। সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভারতে প্রচারণা দুই দেশের সম্পর্কে আরও বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অন্তর্র্বতী সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের মিথ্যা প্রচারণা নিয়ে প্রতিবাদও করা হয়েছে। তারপরেও ভারতের গণমাধ্যম যে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে, তা উত্তেজনা বাড়াচ্ছে বাংলাদেশে। এসব ঘটনায়

বাংলাদেশ-ভারত পররাষ্ট্রসচিব বৈঠক, গলাতে পারে বরফ–বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্যেই ৯ ডিসেম্বর দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকটি নিয়মিত বলা হলেও উভয় দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিরসনে এই বৈঠক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রিও বলেছেন, আমরা বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে চাই। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও জোরদারের পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক, গঠনমূলক এবং পারস্পরিক স্বার্থ নির্ভর সম্পর্ক চাই।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেন, সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জন্য দুই দেশ একমত হয়েছে। দুই দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অস্বস্তিকর বিষয়গুলোও তুলে ধরা হয়েছে।

অন্তর্র্বতী সরকারের শপথ নেওয়ার আগের দিন এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ স্থিতিশীল না হলে প্রতিবেশীদের পক্ষে তা হবে বিপজ্জনক। বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গ, মিয়ানমার সর্বত্র প্রভাব পড়বে।

কূটনীতিকরা মনে করছেন, বৈঠকটি ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের বরফ গলানোর টার্নিং পয়েন্ট। এখন দেখতে হবে সামনের দিনগুলোতে দুদেশের সহযোগিতা ও যোগাযোগের মাত্রা কতটুকু বৃদ্ধি পায়।

শপথ নেওয়ার পরবর্তী সময়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ভারত আমাদের প্রতিবেশী, চারদিক থেকেই ভারত আমাদের আছে। কাজেই তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হওয়া উচিত।

তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে বৈরি সম্পর্ক রেখে কেউ লাভবান হবে না। আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা হবে সবচেয়ে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। বন্ধুত্বের শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।

ড. ইউনূস বলেন, হাসিনা ব্যতীত বাংলাদেশের সবাই ইসলামবাদী, ভারতকে এই ধারণা থেকে বের হতে হবে। বাংলাদেশ তাকে (হাসিনা) ফেরত আনবে। কারণ এটাই জনগণের চাওয়া।

জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ভারত ইচ্ছা করেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে চাচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করতে প্রতিবেশী দেশ ভারত সংখ্যালঘু কার্ড খেলতে চেয়েছিল। এ দেশে কোনো সাম্প্রদায়িক বিভাজন নেই।

ভারতের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের দেশের এক ইঞ্চি কেন, আধা ইঞ্চি জায়গাও ছেড়ে দেব না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ যে সম্পর্ক থাকা দরকার ছিল, সেটি ভারতের পক্ষ থেকে বজায় রাখা হয়নি। তা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন। আর ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে, এমন মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ভারত সবসময় তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ওপর প্রভুত্ব করেছে, যা কারও জন্যই শুভ নয়। ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী ও বন্ধু। অশা করি দুই দেশের মধ্যে সৃষ্টি হওয়ার সমস্যা দ্রুতই সমাধান হয়ে যাবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের পেছনে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রভাব।সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই দেশকেই কো-অপারেটিভ হতে হবে। রাষ্ট্রের অবস্থান থেকে বাংলাদেশ চেষ্টা করবে। আর ভারতকেও তার রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান মেনেই তার আচরণ নির্ধারণ করতে হবে। বিদ্যমান কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে উভয় দেশের পরস্পর নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করা যায়। এটা না হলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধিতা বাড়তে থাকবে।

৫৮ বার পড়া হয়েছে।

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।