ক্যারিয়ারের সময়সীমা মাত্র চার বছর, আর তাতেই হয়েছিলেন খ্যাতিমান। বলছি ঢাকাই সিনেমার ক্ষনজন্মা নক্ষত্র সালমান শাহের কথা।ঢালিউডের জনপ্রিয় নায়কদের মধ্যে এখনো তাকে সহজে আলাদা করা যায়। যার অভিনয় ও স্টাইলে এখনও মুগ্ধ বর্তমান প্রজন্মের দর্শকেরা।
সালমান শাহর মৃত্যুর প্রায় ২৯ বছর কেটে গেছে। এতদিন পরও রমেশের চোখ বন্ধ করলে ভেসে ওঠে—ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিস্তব্ধ ঘরে শুয়ে থাকা নায়ক সালমান শাহর মরদেহ। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না, তাদের প্রিয় নায়ক আর নেই।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সবাইকে বিস্মিত করে না ফেরার দেশে চলে যান নায়ক সালমান শাহ। মৃত্যুর এত বছর পরও দর্শক হৃদয়ে আজও বেঁচে আছেন ঢালিউডের হার্টথ্রব নায়ক সালমান শাহ।
হাসপাতাল মর্গের সেই সময়ের তরুণ ডোম রমেশও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না—তারও প্রিয় নায়ক সালমান শাহ মারা গেছেন। প্রিয় নায়কের লাশটা আবার তাকেই কাটতে হবে ময়নাতদন্তের জন্য।
২৯ বছর আগে সালমান শাহের মৃত্যুর পর লাশ আনা হয় ঢামেকের মর্গে। ময়নাতদন্তের সময় ডোম ছিলেন ঢামেক হাসপাতালের সরকারি কর্মচারী রমেশ। পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, নাম হয় সেকেন্দার।
২৯ বছর আগে চিত্রনায়ক সালমান শাহের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা করতে গত সোমবার (২০ অক্টোবর) আদেশ দিয়েছেন আদালত। মামলাটি তদন্তের জন্য রমনা থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জান্নাতুল ফেরদৌস ইবনে হক।
বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) সেই রমেশ প্রকাশ সেকেন্দার দেশের একটি গণমাধ্যমকে বলেন, শুনেছি প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহ মৃত্যুর বিষয়ে আবারও লেখালেখি হচ্ছে। আমরা তো অত বুঝি না, তবে শুনেছি এবার পরিবার হত্যা মামলার অনুমতি পেয়েছে।
তিনি বলেন, চিত্রনায়ক সালমান শাহর ভক্ত ছিল এদেশের লাখ লাখ মানুষ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এদের মতো সে সময় আমিও ছিলাম একজন। হঠাৎ শুনতে পেলাম সালমান শাহ মারা গেছেন, লাশ আনা হচ্ছে মর্গে। হয়তো সেদিন বন্ধের দিন ছিল, মানে সরকারি ছুটি শুক্রবার। লাশ নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ নিয়ে এলো মর্গে। সে সময় মর্গে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। এদের মধ্যে ছিলেন চলচ্চিত্রের তখনকার নামিদামি নায়ক-নায়িকাসহ শোবিজ জগতের প্রায় সব মানুষজন। মর্গের সামনে হাজার হাজার মানুষ—সবাই অঝোরে কাঁদছে তাদের প্রিয় নায়ক সালমান শাহর জন্য। কেউ যেন তখনকার তুখোড় জনপ্রিয় সালমান শাহর মৃত্যুর বিষয়টি মেনে নিতে পারছে না।
এই ডোম বলেন, ৩৫ বছর চাকরি শেষে বর্তমানে অবসর জীবন কাটাচ্ছি। হাজার হাজার লাশ কেটেছি। কিন্তু সালমানের লাশে হাত দেওয়ার স্মৃতি ভোলার নয়।
তিনি আরও বলেন, তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ এত আধুনিক ছিল না। পুরাতন মর্গে লাশটি নেওয়া হলো। চিকিৎসকের নির্দেশে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করি আমি। আমার প্রিয় নায়কের বুকে আমি নিজেই ছুরি চালাই। ফরেনসিক চিকিৎসকে নির্দেশে ময়নাতদন্তের সময় সবকিছুই করতে হয়।
লাশকাটা ঘরে ডোমদের প্রধান কাজ হলো ফরেনসিক ডাক্তারদের সহকারী হিসেবে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ প্রস্তুত করা এবং তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেলাই করা। তাদের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে মরদেহ পরিষ্কার করা, কাটা-ছেঁড়া করা এবং পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করা। এছাড়া তারা লাশ কাটা-ছেঁড়ার পর সেলাই করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেন।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর নিউ ইস্কাটন গার্ডেন এলাকার ভাড়া বাসায় পাওয়া যায় অভিনেতা চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন ওরফে সালমান শাহের লাশ। বাংলা সিনেমায় তার জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি তখন আকাশচুম্বী।
সে সময় এ বিষয়ে অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেন তার বাবা প্রয়াত কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। এরপর ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ এনে মামলাটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার আবেদন জানান তিনি। ওই সময় অপমৃত্যুর মামলার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়টি একসঙ্গে তদন্ত করতে থানা পুলিশের পরিবর্তে সিআইডিকে নির্দেশ দেন আদালত।
মাঝে কয়েক দফা তদন্তে সালমানের মৃত্যুকে আত্মহত্যা উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তবে তা বরাবরই নাকচ করেছেন সালমানের মা নীলা চৌধুরী।
এ অবস্থায় ২০১৬ সালের শেষ দিকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নতুন করে এ মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে পিবিআইও জানায়, সালমান আত্মহত্যা করেছেন। ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ৬০০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম।
প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করেন সালমান শাহের মা নীলা চৌধুরীর আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ। ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর সেই আবেদন খারিজ করে দেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ। এরপর সেই আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন মামলা করেন নীলা চৌধুরী।
আদালতের আদেশের পর সেদিন রাতে সালমান শাহের মা নীলা চৌধুরীর পক্ষে তার ভাই মোহাম্মদ আলমগীর কুমকুম রমনা মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। এতে সালমান শাহের সাবেক স্ত্রী সামিরা হকসহ মোট ১১ জনকে আসামি করা হয়। অপর আসামিরা হলেন- সামিরা হকের মা লতিফা হক লুসি, ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই, খলনায়ক ডন, ডেভিড, জাভেদ, ফারুক, রুবী, আব্দুস ছাত্তার, সাজু, রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ।
গত ২০ অক্টোবর ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জান্নাতুল ফেরদৌস ইবনে হক ওই আবেদন মঞ্জুর করেন এবং সালমান শাহের মৃত্যুর ঘটনায় রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) হত্যা মামলা গ্রহণ ও তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।