সিলেট নগরীর কালিঘাট এলাকায় আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে পুরনো চোরাকারবারি চক্র। নতুন কিছু পুলিশ কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে পুরনো সিন্ডিকেট পুনরায় ভারতীয় পণ্য চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত এক সপ্তাহে অন্তত ৩০ কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য কালিঘাটের বাজারে প্রবেশ করেছে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ-সূত্র জানায়, চোরাচালান কার্যক্রমে সিলেট কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি ও এয়ারপোর্ট থানার এক সেকেন্ড অফিসার জড়িত থাকতে পারেন। স্থানীয় কয়েকজন ক্যাডার ও চাঁদাবাজও এতে সহযোগিতা করছে। ভারতের হরিপুর সীমান্ত থেকে এসব পণ্য আনছে ‘তরিকুল সিন্ডিকেট’, আর কালিঘাটের কিছু ব্যবসায়ী এসব পণ্যের রিসিভার হিসেবে কাজ করছেন।
পুরনো নেটওয়ার্কের পুনর্জাগরণ-অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান কোতোয়ালি থানার ওসি পূর্বে মোগলাবাজার থানায় দায়িত্বে ছিলেন। তখনও তার সঙ্গে একটি চোরাচালান চক্রের যোগাযোগ ছিল। সেই গ্রুপের সদস্য শাহেদ, ছালেক ও হুসেন বর্তমানে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। থানার সিসিটিভি ফুটেজেও তাদের একাধিকবার থানায় আসা-যাওয়ার দৃশ্য পাওয়া গেছে।
আগের ওসি মো. জিয়াউল হক দায়িত্বে থাকাকালে কালিঘাটে চোরাচালান বন্ধ ছিল। কিন্তু নতুন ওসি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই পুনরায় পণ্য প্রবেশের পথ খুলে যায়। স্থানীয় সূত্র জানায়, এক সাংবাদিকের সুপারিশে হরিপুরের তরিকুল ওসির ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেন এবং ২২ অক্টোবর থেকে কালিঘাটের ‘লাইন’ আবার সচল হয়।
প্রতিদিন ভোরে কোটি টাকার পণ্য প্রবেশ-তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ভোর ৪টা থেকে ৬টার মধ্যে ট্রাক ও ডিআই পিকআপে ভারতীয় পণ্য কালিঘাটে প্রবেশ করছে। প্রতি চালানে থাকে ৮ থেকে ১৫টি পিকআপ। এসব গাড়িতে করে আসছে আলু, টমেটো, পেঁয়াজ, জিরা, কসমেটিকস ও কিটকেট চকলেট।
আরও পড়ুন — জেলা থেকে মেট্রো রাতের চোরাচালান
পুলিশের অভ্যন্তরে ‘লাইন সিগন্যাল’ সিন্ডিকেট-এসএমপি সূত্র জানায়, এয়ারপোর্ট থানার ওসি সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও তার সেকেন্ড অফিসারসহ কয়েকজন কর্মকর্তা চোরাচালানিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। সোবহানীঘাট, বন্দর ও লামাবাজার ফাঁড়ির কিছু সদস্যও একইভাবে সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ রয়েছে।
এমনকি ডিবি পুলিশের নিচের সারির কিছু কর্মকর্তা ‘সিগন্যাল’ পাঠিয়ে চোরাই পণ্য পাসে সহায়তা দিচ্ছেন। তাদের হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা যাচাই করলে প্রমাণ মেলার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
কালিঘাটে পণ্য প্রবেশের রুট-বটেশ্বর-মুরাদপুর-কানাইঘাট সড়ক হয়ে চালিবন্দর ও সোবহানিঘাটের রাস্তায় আসে এসব পণ্যবাহী গাড়ি। পথে পুলিশ ও কিছু স্থানীয় প্রভাবশালীর ‘সিগন্যাল’ পেয়ে নিরাপদে কালিঘাটে প্রবেশ করে। করিম উল্লাহ মোড় এলাকায় একটি চাঁদাবাজ চক্র পণ্য প্রতি ভাগ নিয়ে কাজ করে—চাঁদা না দিলে মাল আটকে দেওয়ার হুমকি দেয় তারা।
আরও পড়ুন— জৈন্তাপুরে ভারতীয় চোরাইপণ্যের রাজত্ব, প্রভাবশালী নেতাসহ পুলিশের সহযোগিতার অ ভি যোগ
কোথায় মজুদ হয় এসব পণ্য-হরিপুরের তরিকুলের পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে কালিঘাটের জিরা ব্যবসায়ী মিলাদের গুদামে, চিনির চালান যাচ্ছে রুবু বাবুর কাছে, আর কসমেটিকসসহ অন্যান্য মাল যাচ্ছে সাদ্দাম, সিজিল, ইমন ও আনোয়ারদের কাছে। বর্তমানে পণ্য মজুদের জন্য পেঁয়াজ ব্যবসায়ী নাঈম ও গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায়ী পারভেজের গুদাম ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব পণ্য রাখা হয় ডিসকো গলি সংলগ্ন লালদিঘি মাঠের পাশের ভবনের দ্বিতীয় তলায়।
কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া-কোতোয়ালি থানার ওসি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি কোনো চোরাচালানে জড়িত নই। কেউ যদি এসব করে থাকে, আমি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এসএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, চোরাচালান দমনে কোতোয়ালি থানা পুলিশকে আরও সক্রিয় করা হবে। ডিবি পুলিশকেও নজরদারি বাড়াতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি) শাহরিয়ার আলম জানান, চোরাচালানসহ সব অপরাধ দমনে আমরা জিরো টলারেন্সে আছি। নজরদারি ও টহল বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মু. মাসুদ রানা বলেন, উঠে আসা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কালিঘাটে চোরাচালান বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র-দৈনিক নিরপেক্ষ