খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেন।
টিকেট চেক করতে গিয়ে পার্বতীপুর স্টেশন পার হয়েছি। এক পর্যায়ে সামনে দেখি,একটা ছোট ছেলে জানালার পাশে বেশ কতকগুলো বই নিয়ে চুপ করে বসে আছে। আমার দেড় বছরের ছেলেটার ইদানীং ছবিআলা বইয়ের প্রতি বেশ আগ্রহ থাকায়, আমি থেমে যাই এবং তার থেকে বই নেয়ার ইচ্ছাপোষণ করি।
তার পাশে বসি এবং কৌতুহলবশত তার জীবনের ইতিহাস শুনে ইমোশনাল হয়ে পড়ি। ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করাতেই বলে তার নাম হচ্ছে-জুবায়ের হোসেন তাহসান। তার বয়স কত? বলতেই বলে,বয়স জানি না,স্যার। সে কোথায় থাকে,বলতেই বলে চলতি ট্রেনের ভেতরে অথবা স্টেশনে।
বাবা মা কোথায় জিজ্ঞেস করতেই বলে,আমার মা-বাবা নাই,কোন দিন দেখিও নি!! একজন দাদু কুড়িয়ে পেয়েছেন। সেই দাদুর সাথে দিনাজপুরে থাকত এবং রাত বারোটার পর দিনাজপুর শহরের একটি হোটেলে ফ্রিতে দেয়া খাবার নিয়মিত খেত। বর্তমানে সে পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষের কাছে খাবারের জন্য সাহায্য চাইলে অনেকেই গালমন্দ করতো। এজন্য কিছু টাকা যোগাড় করে সে বই বিক্রি করছে। বই বেঁচে লাভ কত হয় জানতে চাইলে সে বলে ২০০-৩০০ টাকা। তবে দিনকে দিন বই বিক্রির হার নাকি কমতেই আছে। ট্রেনের যাত্রী/অভিভাবকেরা বাচ্চাদের জন্য আর বই নিতে চায় না। বলে,এগুলো সবই নাকি মোবাইলেই পাওয়া যায়।
এজন্য সে মনস্থির করেছে,আর বই বিক্রি না করে,ফুলবাড়ি স্টেশনে সামনে শীতের সিজনে ডিম বিক্রি করবে। এজন্য তার ডেকচি সহ কিছু জিনিস কেনা হয়েছে আর গ্যাসের চুলা,সিলিন্ডার কেনা বাদ আছে যেটা বাবদ লাগবে প্রায় ১৫০০- ২০০০ টাকা। বর্তমানে বই বিক্রি করে সে সেটা যোগাড়ের চেষ্টাই করছে।ছেলেটি সামনে ফুলবাড়ি স্টেশনে নেমে যাবে এবং নামার আগে ৪-৫ মিনিটের আলাপচারিতায় উক্ত কথাগুলোই আমি শুনেছিলাম। তারপর আমি আমার ছেলের জন্য একটি বই পছন্দ করে নিলে সে দাম নিতে অসম্মতি জানাচ্ছিল,যদিও জোর করে দাম দিয়েছিলাম। সে সময়ের পর থেকে আমার বেশ কতকগুলো কথা মনে হচ্ছে।
যেমনঃ যে বয়সে তাহসানের বই হাতে স্কুল যাওয়ার কথা। সে সময়ে সে বই বিক্রি করছে, যে সময়ে তার খাবারের সরবরাহ থাকার কথা। সে সময়ে সে খাবারের জন্য ক্ষুধার সাথে লড়ছে, যে সময়টাতে তার বাবা-মার কোলে মাথা রাখার কথা,সে সময়টাতে সে যাযাবর হয়ে ঘুরছে। আচ্ছা,পৃথিবীটা তাহসানদের জন্য এতটা নিষ্ঠুর কেন?
দুনিয়াতে আসায় তাহসানের কোন হাত নেই,কিন্তু তার জন্য জগতটা এতটা প্রতিকূল কেন? এই তাহসানেরা কি এভাবেই বেঁচে থাকার যুদ্ধে লিপ্ত থাকবে? আচ্ছা? রাষ্ট্র কবে থেকে কালো মানিক তাহসানদের জন্য মানবিক হবে?
লেখা- আব্দুল আলীম বিশ্বাস মিঠু
টিটিই,ঈশ্বরদী হেডকোয়াটার।