
জাফলংয়ের বিট অফিসারকে এসব চাঁদাবাজ,চোরাকারবারি তোয়াক্ষাই করেনা !
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংসহ উপজেলার সব কয়টি নদ-নদীতে চলছে ওপেন চাঁদাবাজী। প্রকাশ্যে চলছে বালু-পাথর লুটপাট। উপজেলার সীমান্ত এলাকা জুড়ে চলছে ভারতীয় চোরাচালান বাণিজ্য।
এসব নিয়ে অবশ্য গোয়াইনঘাট থানার ওসি দরবেশ বাবা ওসি সরকার তোফায়েল আহমদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। কারণ রাত হলে কাঁচা টাকা নিয়ে থানায় হাজির হন এসব চাঁদাবাজরা।
ওসির সাথে সম্পর্ক থাকায় থানা পুলিশের কোন বিট অফিসারকে এসব চাঁদাবাজ/ চোরাকারবারি তোয়াক্ষাই করেনা। বিশেষ করে জাফলং এলাকায় প্রকাশ্য চলে আজির উদ্দিন, সুহেল আহমদ, জাহিদ খান, মিজানুর রহমান হেলোয়ার, সমেদ মিয়া, হযরত আলী, ইবু, পারভেজ ও রুবেলের ওপেন চাঁদাবাজী। এই চক্রটি জাফলংয়ে এলাকায় এক আতঙ্কের নাম। এদের শেল্টারদাতা হচ্ছেন বিএনপি থেকে বহিস্কৃত নেতা রফিকুল ইসলাম শাহপরাণ ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন। এই দুইজন বহিস্কৃত হলেও এরাই মূলত জাফলং লুটের খলনায়ক।
তাদের প্রত্যকের রয়েছে পৃথক-পৃথক গ্যাং। প্রতিটি গ্যাংয়ে রয়েছে ২০/৩০ জনের লাটিয়াল একটি বিশেষ বাহিনী। তবে এরা সঙ্গবদ্ধ ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করে জাফলং এলাকার পাথর রাজ্য ও চোরাচালান সিন্ডিকেট। জাফলং এলাকার চোরাচালানের খলনায়ক ৩নং পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল মান্নান উরফে মান্নান মেম্বার। তিনি নিজেকে পুলিশ-বিজিবি ও জেলা ডিবি পুলিশের লাইনম্যান দাবী করে চাঁদা কানেকশন করেন। চোরাচালানের বিষয়টি তিনি সরাসরি ওসির সাথে ম্যান্টেইন করেন।
সূত্রমতে বিগত বছরে ৫ আগষ্টের পর থেকে জাফলং এলাকায় প্রায় ৩শত কোটি টাকার বালু-পাথর লুটপাট হয়েছে। বিগত ২৬ জুলাই জাফলংয়ে প্রায় ৩ কোটি ৭৪ লাখ ঘনফুট পাথর মজুত ছিল জাফলংয়ে। এরপর ৫ আগস্ট রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে সেখানকার সিসি ক্যামেরা বিকল করে দুষ্কৃতকারীরা টানা দুই সপ্তাহ জাফলং জিরো পয়েন্ট-সংলগ্ন পিয়াইন ও গোয়াইন নদের আশপাশে জমে থাকা অন্তত এক কোটি ঘনফুট পাথর লুট করে নিয়ে যায়। এর আনুমানিক মূল্য ২০০ কোটি টাকা। এ ঘটনায় স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা ১৮ আগস্ট গোয়াইনঘাট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছিলেন। গত বছরের ১৪ অক্টোবর জাফলংয়ে অবৈধভাবে বালু ও পাথর তোলা বন্ধে টাস্কফোর্সের অভিযান চলে। ওইদিন জাফলংয়ে ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত অভিযান চালানো হয় বলে জানিয়ে ছিলেন গোয়াইনঘাটের ইউএনও মো.তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেছিলেন, “অভিযানে অবৈধভাবে পাথর তোলায় ব্যবহৃত ৭০০টি নৌকা, সাড়ে ৮ লাখ ঘনফুট বালু, ১৫ হাজার ঘনফুট পাথর, দুটি পাথর ভাঙার মেশিনসহ আটটি ইঞ্জিন নৌকা, দুটি শ্যালো বোমা মেশিন, তিনটি ট্রাক, তিনটি ডাম ট্রাক, দুটি প্লেলোডার জব্দ করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিজিবি ও পুলিশ যৌথভাবে এ অভিযান চালিয়ে ছিলো।” পাথর লুটপাটের ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তর পৃথক দুইটি মামলা করে। মামলায় মোট আসামি করা হয়েছিলো ১১৪ জনকে।” দুই মামলাই আসামি করা হয় সাবেক সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরাণ এবং সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপনকে। এখন পর্যন্ত জাফলং লুটপাটকারীরা সকলেই শাহপরাণ কিংবা স্বপন বাহিনীর লোক বলে স্থানীয়রা জানান। সম্প্রতি এক মাসে অন্তত ৫ কোটি টাকার বালু লুট হয়েছে এই কয়েকজনের নেতৃত্বে। এরা কাউকে পরোয়া করেনা। কারণ খোদ থানা পুলিশের বিট অফিসারও তাদের কাছে অসহায়। তাদের অপকর্মের প্রতিবাদ করায় বাংলাবাজারের বিএনপি নেতা ও ইউপি সদস্য রিয়াজ তালুকদারের উপর দলবল নিয়ে তারা সশস্ত্র হামলা চালায়। সময় বেশ কয়েকজন আহত হয়ে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কিন্তু এঘটনায় পুলিশ তখন কোন মামলা পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। গত শনিবার (১৪ জুন) দুপুর ১২ টার দিকে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের গাড়ি বহর আটকে স্থানীয় পাথর ও বালু ব্যবসায়িদের নিয়ে বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজির উদ্দিন, গোয়াইনঘাট উপজেলার যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক সুহেল আহমদ। তখন আজির উদ্দিন স্থানীয় পাথর ও বালু ব্যবসায়িদের নিয়ে গাড়িবহর ঘিরে ‘ভুয়া, ভুয়া’ ¯েøাগান দিতে দেখা যায়। বিক্ষোভে কোন শ্রমিককে দেখা যায়নি এখানে সবাই ছিলো পাথর ও বালু ব্যবসায়ি। উপদেষ্টাদের গাড়ি বহর আটকের কারণ জানাতে আজির প্রকাশ্যে এসে পাথর মহাল খুলে দেওয়ার দাবি জানানোর মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। আজির উদ্দিন গোয়াইনঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন শাখা ছাত্রদলের সভাপতি। তার সাথে রয়েছে সিলেট জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুহেল আহমদ, গোয়াইনঘাট উপজেলার যুবদলের যুগ্ন আহবায়ক জাহিদ খান, পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের সদস্য মো. কামাল আহমদ, পারভেজ, রুবেল, চোরাকারবারি ইবু ও হযরত। এরা সকলেই বিগত ৫ আগস্ট পরবর্তী বাস্তবতায় জাফলং এলাকায় বালু-পাথর উত্তোলনে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত হয়। শ্রমিকদের দোহাই দিয়ে পাথর কোয়ারি থেকে চাঁদাবাজি যেনো তাদের নিত্যদিনের সঙ্গি ছিলো। তাদের কারণে জাফলংয়ে পর্যটকরা বিভিন্ন সময় হেনেস্তার শিঁকার হন। এমকি পর্যটকদের উপর হামলার ঘটনাও ঘটে।
জানা গেছে, আজির উদ্দিন ও জাহিদ খান গত (১৩ জুন) রাতে মামার বাজারে বসে পরিকল্পনা করে তাদের লোক জড়ো করে দুই উপদেষ্টাকে হেনেস্তা করতে চেয়েছিলো। পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশের কথা বলে পাথর উত্তোলন বন্ধকরে রেখেছেন তাই তারা ক্ষোভে এমন কাজ করেছে বলে জানা যায়। জাফলংয়ে পিয়াইন নদীর জিরো পয়েন্ট, ঝুম পার ও চা-বাগান এলাকায় চলছে পাথর ও বালু উত্তোলন। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ভোর পর্যন্ত পাথর ও বালু উত্তোলন করে বিক্রি করা হয়। প্রতিটি গাড়ি পাথর তুলতে স্থানীয় ভাবে খরচ হয় ১০ হাজার টাকা, আর তা বিক্রি করা হয় ৩৪ থেকে ৩৬ হাজার টাকা করে। পরিবেশ বিধ্বংসী এই ধ্বংসজজ্ঞের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গোয়াইনঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদলের বহিষ্কৃত সভাপতি আজির উদ্দিন (২৬), ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহ সভাপতি বহিষ্কৃত সুমন শিকদার (২৮), সহ সভাপতি বহিষ্কৃত পারভেজ শিকদার (৩০) ও রুবেল আহমেদ (২৭), পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের সদস্য মো. কামাল আহমদ, ট্রাক চালক সমিতির সভাপতি শ্রমিকলীগ নেতা সমেদ। জাফলং চাঁদাবাজি সহ নানা অপরাদে থাকার কারণে যুবদল নেতা জাহিদ খান ও ছাত্রদল নেতা আজির উদ্দিনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। শনিবার (১৪ জুন) গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খানকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ দল থেকে বহিস্কার করা হয়। সদ্য বহিস্কৃত যুবদল নেতা জাহিদকে প্রধান আসামী করে ১৫৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। মামলায় ৯ জনের নাম উল্লেখ করে বাকী ১৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামী হিসেবে দেখানো হয়েছে। তিনজনকে এ পর্যন্ত আটক করেছে পুলিশ। গত রোববার (১৬ জুন) রাতে গোয়াইনঘাট থানার উপ-পরিদর্শক ওবায়দুল্লাহ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছেন। এদিকে গত ২৫শে মের বাংলাবাজারে বালু পাথর সমিতির নেতৃবৃন্দের ওপর জাহিদ ও জিয়ারতের নেতৃত্বে হামলার ঘটনায় দু’দিনের মাথায় গোয়াইনঘাট থানায় রিয়াজ তালুকদারের পক্ষে শাহাদাৎ হোসেন নামের আহত হওয়া একব্যক্তি থানায় জাহিদ খানকে প্রধান আসামি করে ২৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেন।
গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরকার তোফায়েল আহমেদ জানান, মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বেআইনীভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে অবৈধভাবে গতিরোধ করে বাধা ও অবৈধ ভাবে অবরোধ করে সরকারী কর্মচারীকে সরকারী কাজে বাধাদান করার অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলা নম্বর ১২, তারিখ-১৫/০৬/২০২৫। মামলায় ১৪৩/৩৪১/৩৪২/১৮৬/৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গোয়াইনঘাটে পিয়াইন নদীতে জিয়ারতের নেতৃত্বে এখনো চাঁদাবাজি হচ্ছে। তারা পার্শ্ববর্তী উপজেলা জৈন্তাপুরের সারি-১ নামের একটি বালু মহালের কাগজ দেখিয়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করছে। এ সময় নদীতে চলাচলকারী ভলগেট থেকে পুলিশের নামে ৭ হাজার টাকা করে আদায় করা হয়, যা সম্পূর্ণ অবৈধ।