সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং পাথর কোয়ারি থেকে নির্বিচারে চলছে পাথর লুট। দিন-রাত কোয়ারি সংলগ্ন নদ–নদী থেকে অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে বালু ও পাথর। এতে বিএনপি নামধারী স্থানীয় কয়েকজন নেতার পৃষ্ঠপোষকতা আছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ আছে প্রতি রাতে প্রশাসনের নামে একটি পেলুডার থেকে ১৫ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। প্রশাসনের লাইনম্যান পরিচয়ে ১০/১৫ লোক চাঁদা উত্তোলন করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তবে প্রশাসনের নাম ভাঙ্গিয়ে কেউ টাকা উত্তোলন করেছে প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন গোয়াইনঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ সরকার তোফায়েল ও গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) সাইদুল ইসলাম।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার কোয়ারি থেকে পাথর ও বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশনা দিলেও এরপর থেকে রাতের আঁধারে স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলন চলত। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপি নামধারী একটি সিন্ডিকেট।
স্থানীয়রা জানান, ২০ থেকে ২৫ জন পাথর থেকোর দখলে পুরো জাফলং পাথর কোয়ারি। বিশেষ করে বল্লাঘাট মন্দিরের জুমপার এলাকায় এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে বিশাল আয়তনের ৪০/৫০টি গর্ত করে প্রতিদিন অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। দিনে ৫ শতাধিক লেবার দিয়ে পাথর উত্তোলন করা হলেও রাতে চলে ধ্বংসযজ্ঞ। শতাধিক পেলুডার দিয়ে ড্রাম ট্রাকের মাধ্যমে পাথর পরিবহন করে নিয়ে যাওয়া হয় জাফলং মেলার মাঠে। সেখানে চালুনি করে ফ্রেশ পাথর বাহির করা হয়।
জানা যায়, বেলার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে জাফলংকে পরিবেশ-প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়। এছাড়া পাথর কোয়ারির মূল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডিসি) উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জাফলংসহ সিলেটের আটটি পাথর কোয়ারিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখে। বিএমডিসির ওই সিদ্ধান্ত জেলা প্রশাসন কার্যকর করায় ভারতের নদ-নদীর পানির স্রোতে আসা পাথর আবার জাফলং ও ভোলাগঞ্জে জমতে শুরু করে। গত চার বছরে জমা এসব পাথরই এখন লুটপাট হচ্ছে।
জাফলংয়ের দুজন বাসিন্দা জানান, পট পরিবর্তনের আগে মানুষ আড়ালে-আবডালে বালু উত্তোলন করতো। ৫ আগস্টের পর থেকে প্রকাশ্যে পাথর ও বালু উত্তোলন চলছে। মাঝেমধ্যে টাস্কফোর্সের অভিযান চালালে লুটপাটকারীরা সটকে পড়ে। অভিযানকারী চলে গেলে আবার লুটপাট শুরু হয়। দিনের বেলা পাথর উত্তোলন কম হলেও রাতে অবাধে চলে।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জাফলংয়ে পাথর মজুতের বিষয়টি স্থানীয়ভাবে পরিমাপ করে প্রতি মাসেই হিসাব সংরক্ষণ করত প্রশাসন। সর্বশেষ গত ২৬ জুলাই জাফলংয়ে আনুমানিক ৩ কোটি ৭৪ লাখ ঘনফুট পাথর মজুত ছিল। ৫ আগস্ট রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে সেখানকার সিসিটিভি ক্যামেরা বিকল করে দুর্বৃত্তরা। পরে টানা দুই সপ্তাহ জাফলং জিরো পয়েন্ট-সংলগ্ন পিয়াইন ও গোয়াইন নদের আশপাশে জমে থাকা অন্তত এক কোটি ঘনফুট পাথর লুট করা হয়। এর আনুমানিক মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এ ঘটনায় স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা ১৮ আগস্ট গোয়াইনঘাট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে নয়াবস্তি এলাকা পর্যন্ত গোয়াইন নদের পাড় ধরে যাওয়ার পথে কয়েক শতাধিক বারকি নৌকায় শ্রমিকদের বালু তুলতে দেখা যায়। শুধু বল্লাঘাট অংশেই ছিল ৪০০ থেকে ৫০০ টি নৌকা। কিছু নৌকায় পাথরও দেখা গেল। বালুভর্তি নৌকাগুলো বল্লাঘাট বাজারের পাশে নোঙরের পর নদের পাড়ে বালু ফেলছেন শ্রমিকেরা। পরে সেই বালু ট্রাক ও পিকআপে ভরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। একই পদ্ধতিতে নদসংলগ্ন জাফলং চা-বাগান ও মন্দির জুম এলাকায় বালু লুট করতে দেখা যায়।
বল্লাঘাট বাজারের স্থানীয় এক ব্যক্তি দূরের সারি সারি বারকি নৌকা দেখিয়ে বলেন, গোয়াইনের পানিতে ডুবে ডুবে শ্রমিকেরা বালু তোলেন নৌকায়। একেকটা নৌকায় বালু বোঝাই করতে তিনজন শ্রমিকের ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সময় লাগে। এভাবে দিন-রাত সমানতালে বালু বোঝাই করা হয়। সুযোগ বুঝে পাথর লুটও চলে। জিরো পয়েন্ট-সংলগ্ন পিয়াইন নদেও একইভাবে বালু-পাথর লুট চলছে বলে তিনি জানালেন।
এলাকাবাসী জানান, শ্রমিকেরা বালু তুলে পিয়াইন ও গোয়াইন নদের সাইট কালেকশনকারীর (নৌকা থেকে বালু ক্রেতা) কাছে বিক্রি করেন। বালুভর্তি একটি নৌকা গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কিনে নেন কালেকশনকারীরা। প্রতিটি নৌকায় গড়ে ৫০ ফুটের মতো বালু থাকে। পরে এসব বালু বেশি দামে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। একই আকারের নৌকায় থাকা পাথর দেড় হাজার থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি হয়। একেকটি নৌকায় ৪০ থেকে ৫০ ফুটের মতো পাথর থাকে।