
সিলেটে ডিসি অফিসে কর্মরত অফিস-সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক (রাজস্ব শাখা)’র মোঃ সোহেল আহমদের কাছে ১৭ বছর থেকে জিম্মি হয়েছে আছেন জেলার মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি ও জেলে সম্প্রদায়ের মানুষজন। সিলেট নগরীর খাসদবির এলাকার সৈয়দ মুগনি তরংগো ৪/৩৭ এর বাসিন্ধা মৃত আব্দুল হাশেম এর ছেলে সোহেল আহমদ। এই কয়েক বছরে তিনি হয়েছেন প্রায় শতকোটি টাকার মালিক। গড়েছেন বিশাল সম্পদের পাহাড়। জেলার সব কয়টি বিল ও জলমহালের ইজারা প্রদান করে জেলা প্রশাসকের রেভিনিউ শাখা। সেই শাখা একক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন অফিসের পিয়ন সোহেল আহমদ। তিনি এই শাখা কর্মরত থাকা অবস্থায় সরকারি বিল-জলমহাল ইজারার নামে এবং বিভিন্ন মামলা দেখিয়ে খাসকানেকশনের মাধ্যমে নিজের সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন।
ডিসি অফিসের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, এই রেভিনিউ শাখা থেকে সোহেল আহমদ ঘুষ ও দূর্নীতির মাধ্যমে প্রায় শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার কাছে অফিসের বড়কর্তারাও জিম্মি হয়ে আছেন। বিগত ২০১৭ সালে বিভিন্ন দূর্নীতির অভিযোগে দুদকের একটি টিম সিলেট ডিসি অফিসে অভিযান চালায়। সেই টিমের উপর হামলা করে সোহেলসহ অফিসের কর্মচারীরা। এসময় দুদকের অভিযানিক টিমকে উদ্ধার করতে গেলে কোতয়ালী থানার তৎকালীন ওসি সেলিম মিয়া মারাত্বক ভাবে আহত হন। পরে ডিসি অফিসের অফিস সহকারী আজিজুর রহমানকে ঘুষের টাকাসহ গ্রেফতার করে দুদক। এরপর থেকে অনেক ডিসি রদবদল হলেও সোহেলরা রয়েছেন ঠিকই বহাল তবিয়তে।
সর্বশেষ চলতি বছরের অক্টোবর মাসে সিলেট জেলার ৭৮টি মামলাভুক্ত বিল-জলমহালের তালিকা দিয়ে খাসকানেকশনের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়। এ তালিকায় এমনও বিল রয়েছে কেবল কাগজে কলমে বিল উল্লেখ থাকলেও বিলের অনেকাংশ বেদখল হয়ে আছে, আর এসব বিলের বেশীর ভাগ জমির বেদখলের নেপথ্যের কারিগর এই সোহেল আহমদ। চলতি বছরে মামলাভুক্ত দেখিয়ে যে সে সকল বিলের জন্য দরপত্র আহবায়ন করা হয়েছে, সেই সকল বিল সঠিক ভাবে ইজারা দিলে প্রতি বছর সরকারের ২০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় সম্ভব বলে মন্তব্য করে অনেক মৎস্যজীবি সমিতির সদস্যরা। এমনও দেখা গেছে, ১৯৯৮ সাল থেকে এসব বিল নিয়ে মামলা চলোমান থাকলেও মামলা নিষ্পত্তির কোন উদ্দ্যেগ গ্রহণ করেননি বিগত আমলের কোন জেলা প্রশাসক। কারণ এই সোহেলই সব নাটেরগুরু হয়ে মামলাগুলোর পিছনের কলকাটি নাড়েন। পরে মামলা ভুক্ত দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সমিতির সাথে আতাঁত করে এসব বিল-জলমহালে নামমাত্র মূল্যে খাসকানেকশন আদায় করা হয়েছে ।
এসব সমিতির সাথে সরাসরি সোহেল জড়িত হয়ে লিজ দিয়ে বছরে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সবকিছু ঠিকটাক থাকলেও সঠিক দরদাতাদের কোন বিল বা জলমহাল ইজারা দেওয়া হয়না। যে সকল সমিতি বা প্রতিষ্টান পিয়ন সোহেলকে খুশি করতে পারেন, সে সকল সমিতিকে এসব বিল ইজারা বা লিজ দেওয়া হয়। এমন ভানুমতির খেলা চলে সিলেট ডিসি অফিসের রেভিনিউ শাখায়।
অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, যে সকল ইজারাদার বা সমিতি সোহেলের বিরুদ্ধে গিয়ে বিল ও জলমহাল ইজারায় অংশ গ্রহণ করেন। তারা বেশী দাম দিলেও এসব সমিতি বিল বা জলমহাল ইজারা পায় না। ইজারা পায় এ সকল সমিতি যারা সোহেলের সাথে গোপন চুক্তি করে তাকে একটি অংশ বা শেয়ারসহ পাশাপাশি নজরানা দিয়ে খুশি করতে পারেন। নতুবা বিভিন্ন অযু হাতে সঠিক বা বেশী দরদাতা সমিতির দরপত্র গায়েবসহ, বাতিল হয়ে যায় মুদ্রাক্ষর ভুল দেখিয়ে।
সম্প্রতি সিলেট জেলা প্রশাসনের মামলাভুক্ত তালিকায় রয়েছে জেলার ৭৮টি বিল ও জলমহাল। এ তালিকায় যে সকল বিল ও জলমহাল মামলা ভুক্ত দেখানো হয়েছে, জেলা প্রশাসক অফিস চাইলে এই সমস্যা বা মামলা মাত্র এক বছরে নিষ্পত্তি সম্ভব ছিলো। কিন্ত তা সম্ভব হয়নি শুধু মাত্র সোহেলের জন্য। এদিকে বিভিন্ন অভিযোগে এ পর্যন্ত পর-পর তিন বার রেভিনিউ শাখা থেকে অন্যত্র বদলী করা হলেও সপ্তাহের ভিতরে আগের জায়গায় ফিরে আসেন সোহেল। কারণ যেখান মধুর হাড়ি সেখানেই সোহেলের মামার বাড়ি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু মাত্র সিলেট শহরতলীর পাশ্ববর্তী গোলাপগঞ্জ উপজেলার মুরাদপুর এলাকার শৈলশ্বর ও বিলডুবা নামের দুটি সরকারি বিল রয়েছে। দুটিবিলে সরকারি কাগজে কলমে মোট জমির পরিমান যথাক্রমে শৈলেশ্বর বিলে ১৫০.৩ একর, বিলডুবা বিলে আছে ১০৫ একর জমি। কিš‘ গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বিলের জমির অর্ধেক জবর দখল করে নিয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। প্রতি বছর শুধু শৈলেশ্বর বিলের বিভিন্ন প্রান্তে গর্ত করে কোটি টাকার মাটি বিক্রি করে বিলের আকৃতি পরিবর্তন করে ফেলেছেন স্থানীয় নুরুল ইসলাম, রিপন মিয়া, হিলাল আহমদসহ প্রভাবশালীরা। বিগত ২০১১ সাল থেকে শৈলেশ্বর বিল ইজারা আর খাসকানেশনের খেলায় সোহেল হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় কোটি টাকা। বেহাত হয়েছে দুটি বিলের প্রায় ৫০ একর জমি। স্থানীয় কয়েকটি মৎস্যজীবি সমিতির সদস্যদের সাথে কথা হলে তারা জানান, বিগত ২০১১ সালে শৈলেশ্বর ও বিলডুবা বিল দুটি ইজারার জন্য দরপত্র দাখিল করে নিকটবর্তী তুড়–কবাগ গ্রামের আশার আলো মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি।
বেশী দাম দেওয়ার পরও বিলগুলো উক্ত সমিতিকে ইজারা না দিয়ে, ইজারা দেওয়া হয় দূরবর্তী খালোপার গ্রামের প্রত্যাশা মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি ও খালোপার মৎস্যজীবি সমবায় সমিতিকে, দুই বিলই একই গ্রামের। এই দুটি বিল ইজারা নিয়ে টানা তিন বছর দুটিবিলে সেচ দিয়ে শুকিয়ে মৎস্য আহরণ করে এ দুটি সমিতি। এই তিন বছরে সরকারে গ”ছা হয় প্রায় ৩০ লক্ষ টাকার রাজস্ব। তৎকালীন ডিসি খান মোহাম্মদ বিলাল বিষয়টি নিয়ে অনুতপ্ত হয়ে ছিলেন। সেই সময় থেকে শুরু হয় শৈলেশ্বর বিলের জমি বেখল ও মাটি লুটপাট। পরে পূর্বাঞ্চল সেনানিবাস চট্টগ্রাম এর নামে উক্ত দুটি বিলের দখল নেয় সিলেট সেনানিবাসের পাবলিক শাখার (কোম্পানীর অধিনে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী) সেলিম আহমদ, নলু গ্রামের মৃত মতিন মিয়া, খালোপার গ্রামের আশরাফুল ইসলাম টিয়া। এই তিনজন সেনাবাহিনীর নাম ভাঙ্গিয়ে, দুটি বিল বিক্রি করে খালোপার গ্রামের মন্টু মিয়ার কাছে। তার কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। পরে ২য় দফায় আবার এইচক্র দুটি বিল ৬ লাখ টাকায় বিক্রি করে খালোপার গ্রামের ওসমান মেম্বারে কাছে। যদিও বাধ্য হয়ে মন্টুর টাকার বদলে একটি চেক প্রদান করে। তাদের দেওয়া চেকের একাউন্টে কোন টাকা পাননি মন্টু মিয়া। একই সময়ে উক্ত দুটি বিল ইজারা নিতে ডিসি অফিসে দরপত্র জমা দেয় তুড়–কবাগ গ্রামের আশার আলো মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি। কিš‘ বিভিন্ন অযুহাতে সেই সমিতিকে আর বিল দুটি ইজারা দেওয়া হয়নি। পরে আবার ২০১৭ সালে একক ভাবে দুটি বিল ইজারা নিতে দরপত্র জমা দেয় সেই আশার আলো মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি। ইজারাকালে উক্ত সমিতি একক অংশগ্রহণকারী হলেও তাদেরকে ইজারা দেওয়া হয়নি শৈলেশ্বর-বিলডোবা বিল। কিš‘ একই বছরে সোহেল আহমদের সাথে আতাঁত করে কৌশলে বিলডোবা বিলটি ইজারা নেয় গোলাপগঞ্জ উপজেলার শরিফগঞ্জ ইউনিয়নের রাংজিওল বরোদল মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি।
পর্ব-১