সিলেট এখন ভারতীয় চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য। বিগত সরকারে শাসন আমলের শেষ সময় থেকে এখন পর্যন্ত সিলেট সীমান্ত ও এসএমপি এলাকার চোরাচালানের লাগাম টানতে পারেননি প্রশাসনের কোন কর্মকর্তা। যদিও প্রতিমাসের ঘটা করে সরকারি টাকা ব্যায় করে সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের সভাপতিত্বে বসে চোরাচালান প্রতিরোধ টান্সফোসের বৈঠক। উপস্তিত থাকেন বিভাগের প্রশাসনের সর্বচ্চ কর্তাব্যক্তিরা। সেখানে ব্যয় হয় সরকারি অর্থ। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়না এসব সভা করে। বরং চোরাকারবারিদের হাত বদল হয়। আর বখরাবাজির পরিমান বাড়ানো হয় জড়িত প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সিলেটের সাদাপাথর লুটকান্ডের পর প্রশাসনে বেশ রদবদল করা হয়। এসএমপি পুলিশ কমিশনার হিসাবে যোগদের মোঃ আব্দুল কুদ্দুস পিপিএম এবং জেলা প্রশাসন হিসাবে যোগদেন দেশের আলোচিত ডিসি মো. সরোওয়ার আলম। সীমান্তের থানা এলাকার প্রশাসনে আসে ব্যাপক রদ-বদল। কিন্তু কেউই বন্ধ করতে পারেননি ভারতীয় চোরাচালান বাণিজ্য। যদিও মাঝে মধ্যে সীমান্তে বিজির হাতে আটক হয় কিছু চোরাইপন্য। তুলনামূল তা যত সামান্য বলা চলে। সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে এসব চোরাইপন্য দেশে প্রবেশ করে, রাস্তায় টহল পুলিশ, বিজিবি, সেনা বাহিনী, জেলা-মেট্টো ডিবি পুলিশের টহল টিমকে ফাঁকি দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনাসেয়েই যাচ্ছে এসব পণ্য। পাশাপাশি এসব চোরাই পণ্য প্রবেশ করছে সিলেট নগরীর পাইকারী বাজার কালিঘাটে।
সূত্রমতে, প্রতিমাসে শুধু সিলেট সীমান্ত দিয়ে এখন প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে শতকোটি টাকার ভারতীয় চোরাইপন্য দেশে প্রবেশ করছে। গত এক সপ্তাহে সিলেট নগরীর কালিঘাট বাজারে প্রবেশ করেছে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য। চোরাচালানের তালিকায় এবার যোগ হয়েছে জিরা, শষা, টমেটু, ফুসকা, কসমেটিক, শাড়ি, ত্রিপিস, কিট, চকলেট, মাদক ও অস্ত্র। শুধুমাত্র এসএমপি এলাকায় একটি চোরাইপন্যবাহী গাড়ি প্রবেশ করতে পুলিশের লাইনম্যানের কাছে বখরা দিতে হয় ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা। চোরাচালান চক্রের তথ্যমতে, সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা ও এসএমপি এলাকায় নতুন মোড়কে চলছে চোরাচালানের লাইন। পুরাতন চোরাকারিরাই নতুন লাইনম্যানের মাধ্যমে এখন তাদের চোরাইবাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে নতুন করে এসব চোরাকারবারিদের সাথে যুক্ত হয়েছেন জেলা ও এসএমপি পুলিশের কিছু অসাধু কয়েকজন কর্মকর্তা। সারাদেশের পাশাপাশি এখন শুধু মাত্র সিলেট নগরীর কালিঘাটে প্রতি সপ্তাহে প্রবেশ করছে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার ভারতীয় চোরাইপণ্য। আর এসএমপির বিভিন্ন রোড দিয়ে সারাদেশে যাচ্ছে প্রায় শতকোটি টাকার চোরাইপণ্য। কিন্তু প্রতিদিনই এসএমপি নবাগত কমিশনার আব্দুল কুদ্দুসসহ বেশ কয়েকজন ডিসি, এডিসিকে রাস্তায় গাড়িবহর নিয়ে টহল দিতে দেখা যায়। তার পরেও কি করে এসব চোয়াইপন্য শহর হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে এবং এসএমপি নাভিগর্ত কালিঘাট পাইকারি বাজারে প্রবেশ করছে, এমন প্রশ্ন সচেতন মহলের। আমাদের অনুসন্ধান বলছে, এই চোরাচালানের সাথে জড়িত রয়েছেন কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান যিনি এর আগে মোগলাবাজার থানার ওসি ছিলেন। নতুন করে সেই চক্রের সাথে যুক্ত হয়েছেন এয়ারপোর্ট থানার সেকেন্ড অফিসার জুয়েল, আম্বরখানা পুলিশ ফাঁড়ির আইসি মিজানুর রহমান। সোবাহানিঘাট পুলিশ ফাঁড়ি আইসি শিবলু ও টু-আইসি দ্বিপরাজ, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির আইসি সোলেমান আহমদ। এরা সকলেই ভারতীয় চোরাচালানের সাথে জড়িত। এই কয়েকজন পুলিশের লাইনম্যান হিসাবে বুঙ্গার টাকা গাড়ি প্রতি ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে আদায় করেন বুঙ্গারি নাঈম, পারভেজ ও মামুন, হায়দার চক্র।
আরও পড়ুন–জেলা থেকে মেট্রো রাতের চোরাচালান
জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর রোডের রুঙ্গারিদের পুলিশের লাইন চালাচ্ছে নতুন লাইনম্যান তরিকুল ইসলাম তারেক। তরিকুলের সাথে জড়িত রয়েছে জৈন্তাপুর থানা পুলিশের ২নং বিটের সহকারী বিট অফিসার এএসআই শাহীন। জৈন্তাপুর সীমান্তের যেসব স্থান দিয়ে ভারতীয় পন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সেই সব স্থান হলো, কাঁঠালবাড়ি, ডিবির হাওর ও আলু বাগান, মোকাম পুক্তি, শ্রীপুর, রাংপানি, খরমপুর, কদমতলা, কদমখাল, কমলাবাড়ী। উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিনিয়ত গরু-মহিষ, চিনি, চা পাতা, কসমেটিক, নাসির বিড়ি, টেন্ডুল পাতা, মাদক, মোটরসাইকেল, গাড়ির পার্স অস্ত্রসহ ও বিভিন্ন পণ্য দেশে প্রবেশ করছে। তরিকুলের আরেক সহযোগী হচ্ছেন, বিজিবি’র লাইনম্যান হিসাবে পরিচিত ২নং জৈন্তাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এখলাসুর রহমানের ছেলে শাহীন আহমদ। তরিকুল জৈন্তাপুর থেকে সিলেট শহরে মালের গাড়ি প্রবেশ করেন কানাইঘাট মুরাদপুর বাইপাস হয়ে মেন্দিবাগ, ছড়ারপার, হয়ে কালিঘাটে। এই লাইনে তরিকুলকে সহযোগীতা করছেন শাহপরান থানার ওসি নিজে এবং শাহপরান তদন্ত কেন্দ্রের আইসি ও মেট্রো ডিবি ওসি। পুলিশের পাশাপাশি জড়িত রয়েছেন স্থানীয় কিছু ক্যাডার ও চাঁদাবাজ। ভারতীয় এসব চোরাই পণ্যের ‘রিসিভার’ কালিঘাটের চোরাই পণ্যের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। সীমান্ত থেকে ভারতের এসব পণ্য ডেলিভারি দিচ্ছে হরিপুরের তরিকুল ইসলাম তারেক সিন্ডিকেট।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেট কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মোগলাবাজার থানার ওসি ছিলেন। সেখানকার একটি চোরাচালান গ্রুপের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ছিল। সেই গ্রুপের সদস্যরা আগে ওসিকে ম্যানেজ করে মুরাদপুর পয়েন্ট থেকে কানাইঘাট রুটে আসা সকল চোরাই ভারতীয় পণ্যের ট্রাক পাস করতো। সেই গ্রুপে জড়িত ছিলেন শাহেদ, ছালেক ও হুসেন। কোতোয়ালি থানার ওসি হয়ে যোগদানের পর থেকেই থানার ভিতর সেই চোরাকারবারিরা একাধিকবার আসা-যাওয়া করে। যা থানার সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। সেই চক্রের অফার গিলেছেন ওসি। আপের ওসি মো. জিয়াউল হকের কাছে আসতে পারেনি হরিপুরের তরিকুল সিন্ডিকেট। কিন্তু সিলেটের এক সাংবাদিকের সুপারিশে তরিকুলকে কাছে নেন কোতয়ালীর ওসি। চলতি মাসের ২২ অক্টোবর থেকে ওসিকে ম্যানেজ করে টাকা লেনদেন করেন হরিপুরের তরিকুল ইসলাম তারেক। এরপর ওসি মো. জিয়াউল হকের বন্ধ করা কালিঘাটের ভারতীয় পণ্যের চোরাচালানের লাইন ওপেন করে দেন ওসি নিজেই। সেই সঙ্গে চোরাকারবারিদের সঙ্গে এসএমপি পুলিশের কিছু অফিসাররা একজোট হয়েছেন। এই তালিকায়এসএমপির বিভিন্ন ফাঁড়ি ও থানার একাধিক আইসি ও সেকেন্ড অফিসার সম্পর্ক গড়েছেন। কালিঘাটের একাধিক ব্যবসায়ী সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২২ অক্টোবর থেকে সিলেটের কালিঘাটে হরিপুরের তরিকুলের ভারতীয় চোরাচালান পণ্য প্রবেশ করছে সিলেট শহরে। প্রতিদিন ভোর ৪ টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত ট্রাক ও ডিআই পিকআপ যোগে এসব পণ্য ঢুকে শহরের বিভিন্ন রোডে। প্রতি চালানে ৮ থেকে ১৫টি ডিআই পিকআপ থাকে। এসব পিকআপে করে কালিঘাটে প্রবেশ করছে ভারতের আলু, টমেটো, এলসি বড় পেঁয়াজ, জিরা, কসমেটিক্স ও কিটকেট চকলেট। এই কয়েক দিনে কালিঘাটে ৩০ কোটি টাকার ভারতের মাল ঢুকেছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। এসএমপি সূত্র জানিয়েছে, এয়ারপোর্ট থানার ওসি চোরাচালানে নিজে সম্পৃক্ত না থাকলেও তার সেকেন্ড অফিসার ও আম্বরখানা পুলিশ ফাঁড়ির আইসি চারাকারবারিদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এদিকে এসএমপি কমিশনার আব্দুল কুদ্দুস রাতে টহলে বের হলে পিছন থেকে কয়েকটি গাড়ি তাকে ফলো করে। পয়েন্টে পয়েন্টে দাড়িয়ে থাকা চোরাকারবারের লাইনম্যানরা সিগন্যাল পৌঁছে দেয় চোরাকারবারিদের কাছে। ফলে সহজে রোড পরিবর্তন করতে পারে চোরাইপন্য দিয়ে আসা গাড়িগুলো। এদিকে কমিশনারে নির্দেশে বেশ কয়েকদিন থেকে নগরীর বিভিন্ন অসামাজিক আস্থানা ও জুয়ার আসরে সাড়াসি অভিযান চালাচ্ছেন ডিবির নতুন ডিসি শাহরিয়ার আলম সকল অপরাধ দমনে জিরো টলারেন্সে থাকলেও তার নিচের সারির কিছু অসৎ অফিসাররা সিন্ডিকেটে জড়িয়ে প্রতিরাতে ‘লাইল সিগনাল দিয়ে চোরাচালান পণ্য পাস করাতে চোরাকারবারিদের সাহায্য করছেন। ডিবির জড়িত কতিপয় কর্মকর্তা বিদ্যা সাগর ডিবির ডিসির টিমের সিগনাল পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ডিবির দুটি টহল টিমের গাড়ি চালকেরাও এসব চোরাকারবারির কাছে ক্ষুদেবার্তা পাঠাচ্ছেন। তাদের হোয়াটসঅ্যাপ চেক করলে প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। কোতোয়ালি থানার ওসি এয়ারপোর্ট থানার সেকেন্ড অফিসারের সঙ্গে মিলে ভারতের চোরাইপণ্য কালিঘাটে প্রবেশের নেটওয়ার্ক গড়েছেন বলে একাধিক সূত্রে তথ্য পাওয়া গেছে।
এসএমপির বটেশ্বর থেকে মুরাদপুর কানাইঘাট সড়ক ব্যবহার করে চালিবন্দর ও সোবহানিঘাট সড়ক ব্যবহার করছে ভারতীয় চোরাইপণ্যের ডিআই পিকআপ। মাঝখানে পুলিশ ও পাবলিক সিগন্যাল পাচ্ছে পিকআপের চালক ও সঙ্গে থাকা প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলের প্রটোকল বাহকরা। বন্দরবাজার কালিঘাটের করিমউল্লাহ মার্কেটের মোড়ে একটি তথ্যদাতা চাঁদাবাজ চক্র দাঁড়ানো থাকে। তারাও বস্তাপ্রতি একটি ভাগ পেয়ে থাকেন। অপরদিকে হরিপুরের তরিকুল মাল বোঝাই গাড়িগুলো কালিঘাটের ভিতরে জিরা ব্যবসায়ী মিলাদের কাছে জিরা গুদামে পৌঁছে যাচ্ছে অনাসেই। চিনির চালান যাচ্ছে রুবু বাবুর কাছে। বাকি মাল কালিঘাটের ভারতীয় পণ্য বিক্রেতা সাদ্দাম, সিজিল, ইমন ও আনোয়ারের কাছে যাচ্ছে বলে কালিঘাটের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্র আরও জানায়, আগে কালিঘাটের ইমন ছিলেন এক সময় ভারতীয় চোরাচালান পণ্যের ব্যবসায়ীদের ক্যাশিয়ার। বর্তমানে তাকে আড়ালে রেখে নতুন করে কালিঘাটের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী নাঈম ও গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায়ী পারভেজকে দিয়ে চোরাইপণ্য মজুদ করা হচ্ছে। এসব পণ্য লালদিঘি মাঠে যাওয়ার সময় বামের বিল্ডিংয়ের ২য় তলার গুদামে রাখা হচ্ছে।
তবে কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি এসবে জড়িত নই। কেউ যদি কালিঘাটে চোরাচালান ঢুকিয়ে থাকে, আমি খবর নিয়ে বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি) শাহরিয়ার আলম বলেন, আমরা
আবাসিক হোটেলে অনৈতিক কাজ বন্ধে অভিযান জোরালো করেছি। জুয়াড়িদের আটক করতে অভিযান করেছি। চোরাচালান আটকে টহল ও নজরদারি বাড়াতে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পিপিএম (ক্রাইম এন্ড অপারেশনস) মু. মাসুদ রানা বলেন, আমি চোরাচালান বিষয়ে যে অভিযোগগুলো শুনলাম, সে বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। চোরাচালান দমনে আগের মতো এসএমপি সক্রিয়ভাবে কাজ করবে। কালিঘাটের চোরাচালান বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সূত্র- দৈনিক পর্যবেক্ষণ