
ভূমিকম্প-সংবেদনশীলতার দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে থাকা সত্ত্বেও রংপুর নগরীতে ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে চরম উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। বারবার মাঝারি থেকে শক্তিশালী ভূকম্পনের অভিজ্ঞতা এবং বিশেষজ্ঞদের উচ্চ ঝুঁকির সতর্কবার্তা সত্ত্বেও, এই অঞ্চলের মানুষের জন্য দুর্যোগ প্রস্তুতি কার্যত উপেক্ষিত।
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, ভূ-কম্পনের তিনটি জোনের মধ্যে সিলেট প্রথম এবং রংপুর দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
তিনি বলেন, বিশেষ করে যমুনা উপারের মধুপুর ফল্ট ও শিলং ফল্ট এর মাঝামাঝি অবস্থান হওয়ায় রংপুরের ঝুঁকি অনেক বেশি। ১৮ শতকের শেষের দিকে এই অঞ্চলের চিলমারীতে সাড়ে আট মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, যার ফলস্বরূপ যমুনা নদীর উৎপত্তি ঘটে।
রংপুর ও সংলগ্ন এলাকা অতীতে শক্তিশালী কম্পনের সাক্ষী। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল দুপুরে রিখটার স্কেলে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প ২৫ থেকে ৩০ সেকেন্ড স্থায়ী হলে আতঙ্কে মানুষজন খোলা মাঠে আশ্রয় নিয়েছিল। একই বছর ৫ জানুয়ারি ৬.৭ মাত্রার এবং ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। সবশেষ গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) নরসিংদীর ঘোড়াশাল ছিল উৎপত্তিস্থল, যা রংপুরেও বড় ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
তার আশঙ্কা, বিগত ২১ বছরে রংপুর অঞ্চলে কোনো বড় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল না থাকায়, এবার কম্পনের উৎপত্তি হলে তা সাত মাত্রার বেশি হতে পারে। ভূমিকম্পনের বড় কারণ হিসেবে তিনি ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমে যাওয়াকে চিহ্নিত করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২৯ বছর আগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় রংপুরকে ভূমিকম্পের রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করলেও, কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
নগরীতে বিল্ডিং কোড না মেনে অবাধে গড়ে উঠছে অসংখ্য বহুতল ভবন, যা ঝুঁকির মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়েছে।
২০১৬ সালে রংপুর নগর ভবন ৪৭টি সরকারি স্থাপনার একটি তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ট্রেজারি ভবন, সার্কিট হাউজ (পুরাতন)-সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভবনের নাম ছিল। এর মধ্যে কয়েকটি ভবন ছাড়া বাকিগুলোতে সাময়িক সংস্কার করে এখনও কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
২০২০ সালে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা ও তাৎক্ষণিক উদ্ধার কাজের প্রস্তুতি নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছিল, যেখানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অংশ নিয়ে সুপারিশমালা সরকারের উচ্চ দপ্তরে পাঠিয়েছিলেন। তবে সেই প্রস্তাবের অগ্রগতি সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না।
রংপুর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বাদশা মাসুদ আলম স্বীকার করেছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই অঞ্চল ঝুঁকিতে এবং ৬ মাত্রার বেশি কম্পন হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি প্রয়োজনীয় উপকরণের সংকটের কথাও উল্লেখ করেন।
ফায়ার সার্ভিস জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ২০০৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত এই অঞ্চলে মোট ১৮৫ বার ভূমিকম্প হয়েছে। ২০২০ সালেই কম্পনের সংখ্যা ছিল ৭৪ বার, যার মধ্যে ৫ থেকে ৬ মাত্রার কম্পন হয়েছিল ৬ বার।