
স্বেচ্ছায় অবসরের আবেদন সিলেটের বিভিন্ন সরকারি দফতরে বাড়ছে চোখে পড়ার মতো। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, গত কয়েক বছরের স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী আগাম অবসরের জন্য আবেদন জমা দিয়েছেন। কেউ ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে, কেউবা মানসিক চাপ বা কর্মপরিবেশ বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরছেন এই আবেদনে। চাকরির নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার আগেই স্বেচ্ছায় অবসরের পথ বেছে নিচ্ছেন চাকুরিজীবীরা।
স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার জন্য আবেদন করা অনেকেই নানা কারণ তুলে ধরছেন। কেউ বলছেন পারিবারিক ব্যস্ততার কথা, কেউ মানসিক চাপ, আবার কেউ বদলি-পদোন্নতির অনিশ্চয়তার কথা উল্লেখ করছেন। কেউ আবার বিদেশে সুযোগ পাওয়া বা নতুন কিছু শুরু করার পরিকল্পনাকে কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। এদিকে দফতরগুলোতে আবেদন বৃদ্ধি নিয়ে সহকর্মীদের মধ্যেও কৌতূহল বেড়েছে। অনেকেই মনে করছেন-সরকারি চাকরির পরিবেশ ও কাজের ধরন পাল্টে যাওয়ার ফলে অনেকেই আগের মতো আর স্বচ্ছন্দবোধ করছেন না।
প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্র বলছে, এই প্রবণতার পেছনে কাজ করছে বদলি, পদোন্নতি-বদলীজনিত অনিশ্চয়তা, পারিবারিক চাপ, আর্থিক পরিকল্পনা, বিদেশে যাওয়ার সুযোগসহ নানা কারণ। অন্যদিকে কিছু জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তিত ব্যবস্থাপনা ও নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারাও অনেককে আগেভাগেই অবসরের পথে ঠেলে দিচ্ছে। এদিকে স্বেচ্ছায় অবসরের এ ধারাবাহিকতা নিয়ে সাধারণ কর্মীদের মাঝেও তৈরি হয়েছে কৌতূহল। অনেকেই মনে করছেন, এ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রশাসনের ভেতরে আরও গভীর কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছুই জানায়নি সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো।
সিলেটের সিভিল সার্জন মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে কর্মরত কোনো ব্যক্তি যদি শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতার কারণে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তবে তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন জমা দিতে পারেন। এ ধরনের আবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পুলিশসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে নিয়মিত আসে। এইসব আবেদনের প্রেক্ষিতে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডে উপস্থিত থাকেন সংশ্লিষ্ট খাতের দায়িত্বশীল বিশেষজ্ঞরা এছাড়া সিভিল সার্জন অফিসের প্রতিনিধিরা। বোর্ড আবেদীত ব্যক্তির সকল কাগজপত্র ও প্রাসঙ্গিক তথ্য যাচাই-বাছাই করে। যথাযথ মূল্যায়নের পর বোর্ড সিদ্ধান্ত দেয় যে আবেদনটি মঞ্জুর করা হবে কি-না। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধুমাত্র উপযুক্ত শারীরিক বা মানসিক সমস্যার কারণে যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী অবসর নিতে চান তাদের আবেদনই বৈধভাবে মঞ্জুর হয়।
সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সর্বশেষ তথ্য জানায়, গত ৩ বছরে (২০২২ থেকে ২০২৪) পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে মোট ১১০টি আগাম স্বেচ্ছায় অবসরের আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৫৬টি আবেদন গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হলেও ৫৪টি আবেদন বাতিল করা হয়েছে। অর্থাৎ, জমা পড়া মোট আবেদনগুলোর প্রায় অর্ধেকই অক্ষমতার প্রমাণে টিকতে পারেনি।
২০২২ সালে আগাম অবসরের আবেদন জমা পড়ে ২৮টির মধ্যে ১৬ জনের আবেদন গৃহীত হয় এবং বাকি ১২ জনের আবেদন বাতিল করা হয়। ২০২৩ সালে আবেদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩০টিতে। এই ৩০টি আবেদনের প্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাই করে মোট ১৫টি আবেদন গৃহীত হয় এবং বাকি ১৫টি আবেদন বাতিল হয়। ২০২৪ সালে আবেদন দ্বিগুণ হারে বেড়ে দাঁড়ায় ৫২টিতে। এই ৫২টি আবেদনের মধ্যে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার জন্য ২৫টি আবেদন মন্জুর করা হয়েছে এবং বাকি ২৭টি আবেদন বাতিল করা হয়। যে আবেদনগুলো বাতিল করা হয়েছে সেগুলো বোর্ড যাচাই-বাছাই করে আবেদনের সত্যতা পায় নি বলে সেগুলো খারিজ করা হয়েছে বলে জানায় সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয়।
প্রতিবছর আবেদন বাড়লেও অনুমোদনের হার সে তুলনায় সমানুপাতিক নয়। বরং বাতিলের হার বাড়ছে, বিশেষ করে ২০২৪ সালে বাতিলের সংখ্যা সর্বোচ্চ। মেডিকেল বোর্ডের যাচাইয়ে অধিকাংশ বাতিল হওয়া আবেদনে উল্লেখিত অক্ষমতার দাবির যথেষ্ট ভিত্তি পাওয়া যায়নি। অবসরের আবেদনকারীদের মধ্যে রয়েছেন পুলিশ সদস্য, শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, স্থানীয় দপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মচারী থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও। সরকারি চাকরিতে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন, ক্রমবর্ধমান কর্মচাপ এবং আর্থিক-ব্যক্তিগত সংকট। সব মিলিয়ে অনেকেই আগাম অবসরের পথ বেছে নিতে চাইছেন বলে মনে করছেন প্রশাসনের কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসরের বিদ্যমান বিধি অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মচারী ২৫ বছর চাকরি পূর্তির পর পেনশন সুবিধাসহ অবসরে যাওয়ার সুযোগ পান। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৪৪ ধারা ঐচ্ছিক অবসরের আইনি ভিত্তি প্রদান করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সাধারণত তিন মাস আগে লিখিত নোটিশ দিয়ে এই অবসর গ্রহণ করতে হয়। তবে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন তুলনামূলক আরও নমনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, চাকরিতে ১৫ বছর পূর্তিতেও পেনশন সুবিধাসহ স্বেচ্ছায় অবসরের সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান। বাস্তবায়িত হলে নতুন পরিপত্র জারি করা হবে। অবসরের পর পেনশন সুবিধা নির্ভর করে চাকরির মোট মেয়াদের ওপর। নির্দিষ্ট সময় পূর্তিতে কর্মচারীরা সর্বশেষ মূল বেতন বা শেষ ১০ মাসের গড় বেতনের নির্দিষ্ট শতাংশ হিসেবে পেনশন পান। যেটি কর্মচারীর জন্য বেশি সুবিধাজনক হয়।
প্রচলিত বিধান অনুযায়ী, চাকরিকাল ৫ বছর পূর্তিতে ২১ শতাংশ এবং ৬ বছর পূর্তিতে ২৪ শতাংশ পর্যন্ত পেনশন পাওয়ার নজির রয়েছে। তবে এসব হার সংশ্লিষ্ট বিধিমালার ওপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি ন্যূনতম পেনশনের একটি সীমা নির্ধারিত থাকে যা বর্তমানে সর্বনিম্ন ৯ হাজার টাকা।
পেনশন ছাড়াও কর্মচারীরা গ্র্যাচুইটি, অবসর-পরবর্তী ছুটির আর্থিক সুবিধা এবং অন্যান্য প্রাপ্য সুবিধা পেয়ে থাকেন। চাইলে ছুটিরত অবস্থায়ও স্বেচ্ছায় অবসরের আবেদন করা যায়। তবে আবেদনপত্রে ছুটির সময়কাল ও কার্যকর তারিখ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয়।