
গোয়াইনঘাটের দুটি বালু মহাল থেকে সিন্ডিকেট করে দুই বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকার বালু হরিলুট করা হয়েছে। সরকারি মূল্য নির্ধারণের পরেও সিন্ডিকেট করিয়ে ইজারা না দিয়ে লুট করা হয়েছে বেশ কটি বালু মহাল। মাত্র তিনটি বালু মহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে। এই তিনটি ছাড়া বাকি বালু মহালে দিনরাত অবৈধ বালু উত্তোলন হলেও সিন্ডিকেটের কারণে উপজেলা প্রশাসন দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করছে।
অভিযোগ উঠেছে, সাবেক ইউএনও তৌহিদুল ইসলাম ও বর্তমান ইউএনও রতন কুমার অধিকারী সিন্ডিকেটের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকার ভাগ পেয়ে এসব সরকারি বালু মহাল লুটপাটে গোপনে সহযোগিতা করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গোয়াইনঘাট ব্রিজের দক্ষিণ পাশের লেংগুড়া ও চারিগ্রাম বালু মহাল শুধু লিজ দেওয়া হয়েছে। এই ব্রিজ থেকে উত্তর-পূর্ব দিক বল্লাঘাট ডাউকি ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার নদীপথ ইজারা দেওয়া হয়নি। কারণ, এটা পরিবেশের গেজেটভুক্ত ইসি নিষিদ্ধ এলাকা। এখানে মহামান্য হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টের রিট পিটিশন (নং ৭৭৯১/১৯) অনুসারে নিষেধাজ্ঞা জারি বিদ্যমান রয়েছে। পিয়াইন নদীর এই অংশে এক ফোঁটা পানি নড়াচড়া ও মাছ ধরা নিষিদ্ধ আছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর ইজারা ছাড়াই এই অংশের কয়েক কোটি টাকার বালু হরিলুট করা হয়েছে। স্থানীয় সিন্ডিকেট ইউএনওকে ম্যানেজ করেই বালু লুটপাট করেছে বলে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ আছে।
আরও উল্লেখ্য যে, ফতেহপুর ইউনিয়নের ফতেহপুর বালু মহালের সরকারি মূল্য ধরা হয়েছিল ৫ কোটি টাকা। অভিযোগ আছে, পরিকল্পিতভাবে সিন্ডিকেটের পরামর্শে কাউকে এই বালু মহালটি ইজারা রাখতে দেওয়া হয়নি। অথচ বাস্তবে, লাইনম্যানের মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে এই বালু মহালের বালু লুট করা হয়েছে। দুই বছরে ইউএনও তৌহিদুল ইসলাম থেকে ইউএনও রতন কুমার অধিকারী পর্যন্ত এখানকার বালু মহাল ইজারা না দিয়েই প্রায় ১৫ কোটি টাকার বালু লুট করা হয়েছে।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ হচ্ছে, লুটের ভাগ পেয়েছেন ইউএনও, আর রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে সরকার ও ধ্বংস হচ্ছে গোয়াইনঘাটের নদীর প্রতিবেশ। ডাউকির মুখ থেকে পশ্চিম দিকে সংগ্রামপুঞ্জি, লামাপুঞ্জি, নকশিয়াপুঞ্জি, প্রতাপপুর পুঞ্জি, হাজিপুর বাজার, লাঠি, কালিজুড়ি, লাবু, পরগনা, আহারকান্দি, আমবাড়ি, পর্ণগ্রাম, মনরতল, বগলকান্দি, বুজারকান্দি, মনইকান্দি, ইসলামাবাদ, মুরামুরিখাল, পান্থুমাই, বাবুরকোনা পর্যন্ত এর ভিতরে আরও প্রায় ২৫ কিলোমিটার ইজারা দেওয়া হয়নি। কিন্তু এসব বালু মহাল থেকে গেল দুই বছরে ১৫ কোটি টাকার বালু লুট করে নেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন বালুভর্তি নৌকা হাদারপার হয়ে ছাতকে যাচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন শ্রমিক ধরে অভিযান শেষ করে। জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ও জরিমানা করছে না। উপজেলার সামন দিয়ে সালুটিকর ছেঙ্গেরখাল হয়ে প্রতিদিন শত শত ভলগেট নৌকা লুটের বালু নিয়ে যাচ্ছে। এসব নৌকা আটকানোর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গোয়াইনঘাট উপজেলার ইউএনও অফিসের সামনেই নদী বয়ে গেছে। ওই নৌপথে বাল্কহেড খালি নৌকা উজানের দিকে যায়। বালু ভর্তি করে আবার ইউএনও অফিসের সামন দিয়েই ছাতকে যায়। প্রতিদিন শত শত নৌকা যাওয়া-আসা করলেও ইউএনও কার্যকর কোনো অভিযানে যাচ্ছেন না।
গোয়াইনঘাট ইউএনও অফিসের উত্তর-পূর্ব দিকে কোয়ার্টার কিলোমিটারের মাথায় গোয়াইন গ্রামের কালা মিয়ার বাড়ির সামনে লুনি গ্রামের কামরুল-খয়রুল, যুবদল নেতা শনিরগ্রামের আব্দুস সাত্তার, হাদারপারের সেবুল, ছৈলাখালের আনসার আলী খানের ছেলে যুবদল নেতা জাহিদ খান, গোয়াইন গ্রামের যুবদল নেতা রুহুল আমিন, গোয়াইন দিঘির উত্তরপারের বিএনপি নেতা মনিরুল করিম, তিতারাই গ্রামের বিএনপি নেতা আবদুল মতিন, মতিনের ছেলে শুভ, মতিনের বোনের জামাই কালা মিয়া, তার ছেলে জয়নাল, লেংগুড়ার যুবদল নেতা বুলবুল, লেংগুড়া গ্রামের জাহাঙ্গির, পূর্ণানগরের ফারুক আহমদ, আমবাড়ির দেলওয়ার হোসেন মেম্বার, তারুখালের নজমুল ইসলাম, দক্ষিণ প্রতাপপুরের লনি, একই গ্রামের হেলাল উদ্দিন মেম্বার, বল্লাঘাটের হেনরি খাসিয়ার ম্যানেজার নুর আহমদ, প্রতাপপুর পুঞ্জির শুধাংশু শেখর পালের ছেলে এবলিশ, লেংগুড়া গ্রামের আবদুল হকের ছেলে যুবলীগ নেতা ডেভিল রাসেল, তার বোনের জামাই নিজাম উদ্দিন শায়েস্তা, হাদারপারের ফয়সল আহমদ, খলামাধব গ্রামের জালাল উদ্দিন মেম্বার, হেলাল উদ্দিন, বাউরভাগ হাওরের নজরুল ইসলাম শিকদার, জব্বার মিয়া, ইসলামপুরের আবদুল্লাহ, প্রতাপপুরের মাহবুব হোসেন, কালিজুড়ির খোকন আহমদ, ছৈলাখালের সারোয়ার হোসেন, আমবাড়ির স্বপন, ঢালালপারের খোরশেদ আলম, লাঠিগ্রামের সিদ্দিক উল্লা ও কালিজুড়ির শেরগুল এই বালু লুটপাটসহ চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেল, আওয়ামী লীগের আমলে বালু লুটের গডফাদার ছিলেন সুভাষ-মুজিব। তবে, তারা বৈধভাবে লিজ নিয়ে ইজারার বহির্ভূত এলাকার বালু লুট করতো। এতে কিছু হলেও সরকার রাজস্ব পেয়েছিল। সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরানের আস্থাভাজন গোয়াইনঘাটের সাবেক ইউএনও তৌহিদুল ইসলাম এই সিন্ডিকেটের হয়ে বালু লুটে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ছিল।
উল্লেখ্য যে, ইউএনও তৌহিদুল ইসলামের আমলেও ফতেহপুর বালু মহাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লিজ ফাঁসিয়ে দিয়ে ৫ কোটি টাকার বালু ভাগ করে খেয়েছিল সাবেক সিন্ডিকেট। অবশ্য, সুভাষ-মুজিবের আমলে নৌকা প্রতি ঘনফুট বালুর চাঁদার হার কম ছিল। আগে দুই টাকা করে প্রতি ঘনফুট বালুর চাঁদা তোলা হতো। কিন্তু স্ট্যালিং অনুসারিরা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বিছনাকান্দি, হাজিপুর, হাদারপারে যুবলীগ নেতা ডেভিল বিলাল, যুবলীগ নেতা ডেভিল রাসেল, স্ট্যালিং অনুসারী যুবদল নেতা কামরুল-খয়রুল গংরা প্রতি ঘনফুট বালুর চাঁদা তুলছে ১০ টাকা করে। এতে চলতি বছরে ইউএনওকে ম্যানেজ করে ইজারা ছাড়াই বাড়তি চাঁদাবাজি করেছে ডেভিল রাসেল ও কামরুল-খয়রুলরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) হোসাইন মো. আল-জুনায়েদ বলেন, ‘আমরা প্রতিবছরই এখানকার বালু মহালের টেন্ডার আহ্বান করি। ইজারা না গেলে আমাদের কিছুই করার থাকে না। বালু মহাল ইজারা দেওয়ার এটাই প্রক্রিয়া। ইজারা না গেলে কোনো বালু মহালের বালু লুট করার চেষ্টা করলে প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করে।
গোয়াইনঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রতন কুমার অধিকারী বলেন, ‘আমরা বালু মহালের মূল্য নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দিই। ইজারা দিবে জেলা প্রশাসন। ইজারা ছাড়া যেসব বালু মহালে বালু লুট করা হচ্ছে, সেখানে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘ইজারা না দেওয়া বালু মহালে ১৫ কোটি টাকার বালু লুটের সঙ্গে অবশ্যই আমার কোনো যোগসাজশ নেই।
সূত্র- দৈনিক নিরপেক্ষ
লিংক — গোয়াইনঘাটে অবৈধ বালু উত্তোলন (শেষ পর্ব) সিন্ডিকেট করে ১৫ কোটি টাকার বালু হরিলুট