
সিলেটের তরুণদের জন্য বড় দুঃসংবাদ : যারা ভিজিট ভিসা বা অন্যান্য ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় বা ‘সেটেলমেন্ট’-এর চেষ্টা করতেন—ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন অবস্থান তাদের জন্য একটি বড় ধরনের ধাক্কা। ইতোমধ্যে ফেরত পাঠানো অনেকের অভিজ্ঞতা ও অর্থনৈতিক ক্ষতি সিলেটসহ দেশের অভিবাসন–নির্ভর অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে।
উচ্চশিক্ষাকে সোপান বানিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর সেই আকাঙ্ক্ষা এ বছর বড় ধাক্কা খেয়েছে এইচএসসি পরীক্ষার নিম্ন পাসের হারে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর কঠোর ভিসা নীতি, যা সিলেটের তরুণদের সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরি করছে। বহু স্বপ্নবাজ তরুণ যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথ খুঁজে ফিরলেও সাম্প্রতিক নানা পরিস্থিতি সেই পথ এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় কঠিন করে তুলেছে।
সিলেটের তরুণদের প্রবাস–নির্ভর স্বপ্ন নতুন নয়। স্থানীয়ভাবে সীমিত কর্মসংস্থান, শিল্পায়নের ঘাটতি এবং উন্নত জীবনের আশায় তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিদেশমুখী হয়ে এসেছে।
প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা হওয়া সত্ত্বেও সিলেটের শিল্পায়নের চিত্র হতাশাজনক। হাতে–গোনা কয়েকটি শিল্প-কারখানায় স্থানীয় তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বিপুল রেমিট্যান্স এলেও সেই অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ না হয়ে আবাসন, জমি কেনা ও ভোগ-বিলাসে ব্যয় হচ্ছে। অনেক প্রবাসী কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি নির্মাণ করলেও সেগুলোর বেশিরভাগই খালি পড়ে থাকে—ফলে অর্থ স্থানীয় অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানে রূপ নিচ্ছে না। এই বাস্তবতায় বিদেশে যাওয়াই তরুণদের একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেছে।
অবৈধ পথে যাওয়া বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র : শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে একটি বিশেষ সামরিক ফ্লাইটে ৩৯ জন বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিমানবন্দরে পৌঁছার পর ব্র্যাক তাদের তাৎক্ষণিক সহায়তা ও পরিবহন সুবিধা দিয়েছে। ফেরত আসা ৩৯ জনের মধ্যে নোয়াখালীর ২৬ জন, কুমিল্লা, সিলেট, ফেনী ও লক্ষ্মীপুরের দুজন করে এবং চট্টগ্রাম, গাজীপুর, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও নরসিংদীর একজন করে রয়েছেন। চলতি বছর এ নিয়ে মোট ১৮৭ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে উন্নত বিশ্বে অভিবাসন নীতি কঠোর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপে স্টুডেন্ট ভিসা, ভিজিট ভিসা ও কর্মসংস্থান-সংশ্লিষ্ট নীতি কঠোর হওয়ায় মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশে যাওয়ার পথ আরও সংকুচিত। অনেকে শেষ চেষ্টা হিসেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করছেন—যা বিপদের নতুন দরজা খুলে দিচ্ছে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম জানায়—ফেরত আসাদের মধ্যে ৩৪ জন বিএমইটি ছাড়পত্র নিয়ে বৈধভাবে ব্রাজিলে গিয়েছিলেন এবং পরে সেখান থেকে মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন। বাকি পাঁচজন বিভিন্ন রুটে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান এবং আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়ায় তাদের ফেরত পাঠানো হয়।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান প্রশ্ন তুলেছেন—ব্রাজিলে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হলেও তারা শেষ পর্যন্ত কোথায় যাচ্ছেন, সেটা নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর তদারকি ছিল কি না। তার মতে, ৩০–৩৫ লাখ টাকা ব্যয় করে খালি হাতে ফিরে আসাদের দায়ের জায়গাগুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
যে সব বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল, তাদের হাত-পায়ে শিকল পরানোর অভিযোগ উঠলেও এবার এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে বিমানবন্দর সূত্র জানিয়েছে। ২০২৪ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ২২০ জনের বেশি বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
হোয়াইট হাউসের কাছে গুলিতে এক ন্যাশনাল গার্ড সদস্যের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তে একজন আফগান নাগরিক সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পরই ট্রাম্প এই বিবৃতি দেন। মার্কিন আইনে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অবস্থান করলে আদালত বা প্রশাসনিক আদেশে অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানো যায়। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চার্টার্ড ও সামরিক ফ্লাইটে প্রত্যাবাসনের সংখ্যা বাড়ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অবস্থান নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে : ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন নীতি আরও কঠোর হয়েছে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে অভিবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে, ‘অ–নাগরিকদের’ জন্য সব ধরনের ফেডারেল সুবিধা ও ভর্তুকি বন্ধ করা হবে, রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকি বা বোঝা বলে বিবেচিত হলে যে কোনো বিদেশিকে বহিষ্কার করা যেতে পারে।
কর্মসংস্থানের সংকট, বিদেশে যাওয়ার কঠিন বাধা, আর যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত কড়াকড়ি মিলিয়ে সিলেটের বহু তরুণের স্বপ্নে এখন অনিশ্চয়তার ঘন ছায়া। তাদের অনেকেই বলছেন, ‘আমেরিকার স্বপ্ন এখন ‘আহ’মেরিকা’ হয়ে ফিরে আসছে।