
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই রহস্যের পেছনে রয়েছে ভিন্ন গল্প।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন অঙ্গরাজ্যের উপকূলে এমন এক জায়গা আছে, যেখানে প্রতি মুহূর্তে বিস্ময় ও আতঙ্কের মিশ্র দৃশ্য দেখা যায়। প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউ এসে প্রচণ্ডভাবে আছড়ে পড়ে একটি গর্তে, তারপর সেগুলো ঘূর্ণির মতো নেমে যায় নিচে। মনে হয় যেন সমুদ্রের পানি তলাহীন এক গর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। রহস্যময় এ স্থানটির নাম থর’স ওয়েল।
কেপ পারপেটুয়ার আগ্নেয়শিলা–ঘেরা উপকূলে দাঁড়িয়ে তাকালে মনে হয়, গর্তটি পৃথিবীর গভীরতম নরক–দরজা। কেউ একে বলে ‘সিংকহোল’, কেউ বলে ‘গেট অব হেল’। অনেকের কাছে এটি প্রশান্ত মহাসাগরের ‘ড্রেন পাইপ’ নামেও পরিচিত।
দীর্ঘদিন ধরে থর’স ওয়েলকে একটি বিশাল সিংকহোল মনে করা হলেও গবেষণায় জানা যায় অন্য সত্য। কেপ পারপেটুয়ার শিলা তৈরি হয়েছে আগ্নেয় তাপে জন্ম নেওয়া ব্যাসাল্ট দিয়ে। হাজার বছর ধরে সমুদ্রের শক্তিশালী ঢেউ এসব শিলায় আঘাত করে একটি বড় সাগর–গুহার সৃষ্টি করে। পরে সেই গুহার ছাদ ধসে পড়ে তৈরি হয় গোলাকার খোলা গর্তটি, যা এখন থর’স ওয়েল হিসেবে পরিচিত।
থর’স ওয়েলের সবচেয়ে নাটকীয় দৃশ্য দেখা যায় জোয়ারের সময়। ঢেউ জোরে গর্তে ঢুকলে পানি উল্টো দিক দিয়ে হঠাৎ উপরে উঠে আসে যেন উষ্ণ প্রস্রবণের মতো (গেইজার)। কখনো কখনো ৪০ ফুট পর্যন্ত পানি উপরে উঠে যায়।
চোখে যত গভীর দেখায়, বাস্তবে এর গভীরতা মাত্র ২০ ফুট। শিলার নিচে ছোট ছোট চ্যানেল রয়েছে, যেখান দিয়ে পানি প্রবেশ ও নির্গমন করে। এ কারণেই মনে হয়, বিশাল পরিমাণ পানি যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে।
এই দৃশ্য একই সঙ্গে রোমাঞ্চকর ও ভয়ংকর। ঝুঁকির কারণ: সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্থানীয়দের মতে, থর’স ওয়েলের খুব কাছে যেও না, এটা তোমাকেই গিলে নেবে।
এ সতর্কতা অতিকথা নয়। জোয়ারে ঢেউ এত জোরে আঘাত করে যে গর্তের পাশে দাঁড়ালেই পিচ্ছিল পাথর থেকে পিছলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। হঠাৎ আঘাত করা ‘স্নিকার ওয়েভ’ মানুষকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। ছবি তুলতে গিয়ে বহু দর্শনার্থী বিপদের মুখে পড়েছেন।
কোথায় অবস্থিত? কখন দেখবেন?
অবস্থান: কেপ পারপেটুয়া, অরিগন, যুক্তরাষ্ট্র। হাইওয়ে ১০১-এর ঠিক পাশে।যখন যাবেন না: জোয়ারের সময়, ঝড়ো আবহাওয়ায় বা অতিরিক্ত উচ্চ ঢেউ চলাকালে।
সেরা সময়: জোয়ারের এক ঘণ্টা আগে—তখন পানি ওঠা-নামার দৃশ্য সবচেয়ে স্পষ্ট দেখা যায়।
এটির নাম এসেছে নর্স পুরাণের বজ্রদেব থর-এর নামে। কিংবদন্তি বলে, থর বজ্রাঘাতে শিলা ফাটিয়ে এই গর্ত সৃষ্টি করেছিলেন। যদিও বিজ্ঞানীরা বলছেন এটি সম্পূর্ণই একটি গুহার ছাদ ধসে যাওয়ার ফল।
থর’স ওয়েল যেন প্রকৃতির এক নাটক। জোয়ারে উত্তাল, ভাটায় শান্ত। দেখলে মনে হয় সমুদ্রই তাকে গ্রাস করছে, আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শান্ত হয়ে যায়। ভূতত্ত্ব, সমুদ্রবিজ্ঞান আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য মিলন ঘটেছে এই এক জায়গায়। থর’স ওয়েল তাই শুধু একটি গর্ত নয় এটি পৃথিবীর সময়, শিলা ও সমুদ্রের তৈরি এক বিস্ময়কর প্রাকৃতিক শিল্পকর্ম।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সমুদ্রস্তর ও আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাবে ঢেউয়ের তীব্রতা বেড়েছে। ২০২৪–২৫ সালের ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে—পানির ‘ফুটন্ত’ প্রভাব আগের চেয়ে আরও নাটকীয়। নোয়া জানিয়েছে, কেপ পারপেটুয়ার ব্যাসাল্ট–কাটা এ অঞ্চলে ভবিষ্যতেও নতুন ছিদ্র ও গুহা তৈরি হতে পারে।