সিলেট সীমান্তে দিয়ে ভারতীয় চোরাচালান প্রতিরোধে ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন।
একদিকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) কমিশনার মো. আব্দুল কুদ্দুস (পিপিএম) অপরাধ দমনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, অন্যদিকে তারই অধীনস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িয়ে পড়েছেন চোরাচালান সিন্ডিকেটে। চোরাকারবারিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নতুন নতুন “লাইনম্যান”।
এসএমপি কমিশনারকে সহায়তায় প্রতিদিনই অভিযান পরিচালনা করছেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ডিসি শাহরিয়ার আলম। যদিও অভিযান সফল হলেও, তার আগে থেকেই খবর পৌঁছে যাচ্ছে অপরাধীদের হাতে। ফলে বড় চালান ধরা পড়ছে না, বরং প্রশাসনের ভেতরের অসাধু অংশীদারদের কারণে চোরাচালান কার্যক্রম আগের চেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন —জৈন্তাপুরে ভারতীয় চোরাইপণ্যের রাজত্ব, প্রভাবশালী নেতাসহ পুলিশের সহযোগিতার অ ভি যোগ
প্রতি মাসেই সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আয়োজন করা হয় “চোরাচালান প্রতিরোধ টাস্কফোর্স”-এর সভা। উপস্থিত থাকেন প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা। ব্যয় হয় সরকারি অর্থ, কিন্তু বাস্তবে কোনো ফল দেখা যায় না। বরং সভার পরপরই হাতবদল হয় সিন্ডিকেট, বদলি হয় লাইনম্যান, বেড়ে যায় “বখরা” আদায়ের পরিমাণ।
সাদাপাথর লুটকাণ্ডের পর প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল আনা হলেও চোরাচালানের ধারা অপরিবর্তিত। এসএমপিতে যোগ দেন কমিশনার আব্দুল কুদ্দুস, জেলা প্রশাসনে দায়িত্ব নেন আলোচিত ডিসি মো. সরোয়ার আলম। গোয়াইনঘাট থানায় কিছু পরিবর্তন হলেও জৈন্তাপুর থানা এলাকায় চোরাকারবারিদের সহযোগী কিছু পুলিশ সদস্য বহাল তবিয়তে থেকে যান।
আরও পড়ুন —কালিঘাটে ফের সক্রিয় পুরনো চো রা কারবারি চক্র-আমি কোনো চো রা চালানে জড়িত নই -ওসি
সূত্র জানায়, প্রতিরাতে ভারতীয় পণ্য ঢুকছে সিলেট নগরীর কালিঘাট ও লালদিঘির পার পাইকারি বাজারে। সীমান্তের বিভিন্ন রুট দিয়ে পণ্য আসে, তারপর এসএমপি এলাকার বিভিন্ন রাস্তা পেরিয়ে ঢোকে শহরে। প্রতিমাসে প্রায় শতকোটি টাকার ভারতীয় চোরাইপণ্য দেশে প্রবেশ করছে—যার বড় অংশ যাচ্ছে সিলেট হয়ে।
চলতি সপ্তাহেই কালিঘাট বাজারে ঢুকেছে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য, যার মধ্যে রয়েছে চিনি, জিরা, টমেটো, ফুসকা, কসমেটিকস, শাড়ি, কিট, চকলেট, এমনকি মাদক ও অস্ত্র পর্যন্ত।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চোরাচালানের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছেন এসএমপির কয়েকজন কর্মকর্তা।
তাদের মধ্যে আছেন কোতোয়ালি থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান, এয়ারপোর্ট থানার সেকেন্ড অফিসার জুয়েল, আম্বরখানা ফাঁড়ির আইসি মিজানুর রহমান, সোবহানিঘাট ফাঁড়ির আইসি শিবলু ও টু-আইসি দ্বিপরাজ, বন্দরবাজার ফাঁড়ির আইসি সোলেমান আহমদ।
এই কর্মকর্তারা চোরাকারবারিদের কাছ থেকে প্রতিটি গাড়ি প্রতি ২৮–৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বখরা আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসএমপি সূত্র জানায়, গত অক্টোবর মাসে তারা বিভিন্ন অপরাধে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদক, ভারতীয় পণ্য ও চোরাচালান সামগ্রী উদ্ধার করেছে।
উদ্ধারকৃত সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে:ইয়াবা: ১,৭৩০ পিস,গাঁজা: ৪.২ কেজি,বিদেশী মদ: ৭১৩ বোতল,চোলাই মদ: ১৪৫ লিটার,ফেন্সিডিল: ২১ বোতল।
আরও পড়ুন–বৈঠক আর কাগজে টান্সফোস-চোরাচালান বন্ধে ব্যর্থ প্রশাসন
ভারতীয় পণ্য: পেঁয়াজ ৭,৯২০ কেজি, কাতান শাড়ি ৩১ পিস, চকলেট ৩,৭৪৩ পিস, বিড়ি ৪,২০,০০০ শলাকা, জিরা ৫২ বস্তা ইত্যাদি।
গ্রেফতার হয়েছে মোট ৭২৫ জন আসামি। তবুও নগরীতে ৩০–৪০টির মতো আবাসিক হোটেলে অসামাজিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর রোড দিয়ে এখন চোরাইপণ্য আসছে নতুন লাইনম্যান তরিকুল ইসলাম তারেকের মাধ্যমে। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন এএসআই শাহীন, কনস্টেবলে আবেদ ( ওসির বডিগার্ড ) ও বিজিবি-লাইনম্যান শাহীন আহমদ।
তরিকুলের সিন্ডিকেট প্রতিদিন ভোরে ৮ থেকে ১৫টি পিকআপে ভারতীয় চিনি, জিরা, টমেটো, কসমেটিকস ও চকলেট এনে সরবরাহ করছে কালিঘাট বাজারে। এই পণ্যগুলো মূলত বিক্রি হচ্ছে ব্যবসায়ী মিলাদ, রুবু বাবু, সাদ্দাম, সিজিল, ইমন ও আনোয়ারের দোকানে।
গত কিছু দিন আগে (২৪ সেপ্টেম্বর) মামার বাজার থেকে শীতের কম্বল নিয়ে একটি টমটম আসছিল। মোড়ে আসার পর সেই গাড়ি আটক করেন আবেদ নামের এক পুলিশ সদস্য। আবেদ নাকি ওসির বডিগার্ড হিসেবে পরিচিত। তিনি কম্বল নিয়ে আসা ব্যক্তির কাছে মালিকের নাম জিজ্ঞেস করেন। সে মালিকের নাম বলার পর ছেড়ে দেন। অন্যদিকে একজন ব্যক্তি সেই মাল আটক ও ছাড়ার ভিডিও তার মুঠোফোনে ধারণ করেন। দিন শেষে সেই খবর পৌঁছে যায় আবেদর কাছে। শুরু হয় খোঁজ—কে কারা কীভাবে! এক পর্যায়ে সেই কম্বল বিক্রেতা ইকবালের সাথে তিনি যোগাযোগ না করে তার সহকর্মী আরেকজন দিয়ে যোগাযোগ করেন।
জানা যায়, ওসির বডিগার্ড আবেদ ও চোরাচালানের লাইনের টাকা আদায় করেন।
প্রতিদিন রাতে কমিশনার আব্দুল কুদ্দুস ও তার টিম টহলে বের হলেও, তার আগেই চোরাকারবারিরা ‘লাইন সিগন্যাল’ পেয়ে যায়। বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থানরত লাইনম্যানরা তথ্য পৌঁছে দেয় চোরাকারবারিদের কাছে, ফলে তারা দ্রুত রুট পরিবর্তন করে পণ্য শহরে প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়।
ডিবি সূত্র জানিয়েছে, ডিবির নিচু পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা ডিসির নাম ভাঙিয়ে চোরাকারবারিদের কাছে ‘সবুজ সঙ্কেত’ পাঠান। হোয়াটসঅ্যাপ ও মোবাইল বার্তার মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান হয়।
কোতোয়ালি থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,আমি এসবের সঙ্গে জড়িত নই। কেউ যদি কালিঘাটে চোরাই মাল ঢুকিয়ে থাকে, আমি খবর পেলে তা বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এসএমপি ডিবির ডিসি শাহরিয়ার আলম বলেন, অনৈতিক কার্যকলাপ ও জুয়া দমনে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। চোরাচালান বন্ধে নজরদারি আরও বাড়ানো হবে।
এসএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মু. মাসুদ রানা জানান,চোরাচালানের অভিযোগগুলো গুরুত্বের সঙ্গে যাচাই করা হচ্ছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন—জেলা থেকে মেট্রো রাতের চোরাচালান
সীমান্ত থেকে শহর পর্যন্ত একাধিক নিরাপত্তা বলয় পার হয়ে প্রতিরাতে ঢুকছে কোটি টাকার ভারতীয় চোরাইপণ্য। বিজিবি, পুলিশ ও প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা এবং কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এখন সিলেট হয়ে উঠেছে ভারতীয় চোরাচালানের প্রধান রুট। প্রশ্ন থেকে যায়—চোরাচালান দমনে সিলেট প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তারা এবার আসলেই কি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন?
সূত্র- দৈনিক পর্যবেক্ষণ