জগন্নাথপুর উপজেলার একমাত্র সরকারি ডিগ্রী কলেজটি এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। উপজেলার উচ্চ শিক্ষার অন্যতম বিদ্যাপীঠটি দীর্ঘ দিন যাবৎ চরম অব্যাবস্থাপনার ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা জীবন হুমকীর মুখে পড়েছে। কলেজটিতে বেহাল অবস্থা বিরাজ করলেও এগুলো দেখার যেন কেউ নেই।
কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততায় অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ভবিষৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
অন্যদিকে কলেজে শিক্ষার কোন পরিবেশ না থাকায় নিজের শিক্ষা জীবন নিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়েছেন দূঃচিন্তায়। বিশেষ করে বখাটেপনার কারনে মেয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন হুমকীর মুখে পড়েছে। বহিরাগত বখাটে ও কলেজের ছাত্র নামধারী বখাটেদের বখাটেপনার কারনে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী কলেজ ত্যাগ করে লেখাপড়া পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে। অনুসন্ধানে অনেক ঘটনাই বেড়িয়ে এসেছে। তবে লোকলজ্জার ভয়ে কেউ নাম প্রকাশ করতে চান না।
কলেজ ছেড়ে দেওয়া শিক্ষার্থীরা জানায়, শিক্ষকদের নিকট অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়না। কারণ শিক্ষকরাও ওই বখাটেদের ভয় করেন। এখানে দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং কোন্দল বিরাজ করছে। একজন আরেক জনকে ঘায়েল করার জন্য বখাটেদের ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। কলেজটি নামেই সরকারী ডিগ্রী কলেজ হলেও বাস্তবে সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। কাগজ, চক-ডাস্টারসহ নেই কোন শিক্ষা উপকরণ। ছাত্রীদের কমনরুমে নেই পানির ব্যবস্থা। নেই কোন কম্পিউটার। কলেজটিতে নিয়মিত ক্লাস বা পরীক্ষা হয় না। মাঝে মধ্যে ক্লাস হলেও মাইক্রোফোন বা সাউন্ড সিস্টেম না থাকায় সুষ্ঠভাবে পাঠদান শিক্ষকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেশী ও এক শ্রেনির উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীদের চিৎকার চেঁচামেচির কারনে মেধাবী শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠ পাঠগ্রহণ খেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শিক্ষকরা উশৃঙ্খল ছাত্রদের ভয়ে কোন শাসন করেন না বলে অনেকেই জানান।
জানা যায়, ছাত্র নামধারী বখাটেরা ক্লাসের মেয়েদের ব্রেঞ্চের মধ্যে বসা থাকলেও জোরপূর্বক উঠিয়ে দেওয়া, কলেজের সিঁড়ি দিয়ে ছাত্রীরা নামার সময় শরীরের সাথে শরীর লাগানো, ছাত্রীদের পথ আগলে থাকা, অশালীন বাক্যে কথা বলাসহ নানান আপত্তিকর অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বখাটেপনার কারনে এক ছাত্রকে শাসালে উল্টো ওই শিক্ষককে নানা ধরনের হুমকী দেয় ছাত্র নামধারী বখাটেরা। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ওই বখাটেরা নানা অপকর্ম করেও রাজনৈতিক সাইনবোর্ড ব্যবহার করার কারনে পাড় পেয়ে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা কিছু বলতে সাহস পান না বলে অনেকেই জানান।
কলেজটিতে বর্তমানে ২ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৭ জন। শুন্যপদ রয়েছে আরো ১৫টি।
চলতি ২০২৩ শিক্ষা বর্ষে ছাত্র- ছাত্রী ভর্তি হয়েছেন ৬৭৫ জন। অথচ শ্রেণী কক্ষের ধারন ক্ষমতা ১০০ জনের। এক শিফটে বিপুল শিক্ষার্থীদের পাঠদান খুবই কষ্টকর।
অভিভাবক আলমগীর হোসেন সিলেটভিউ’কে বলেন, আমার মেয়েকে ভর্তি করে খুবই চিন্তার মধ্যে আছি। এখন দেখছি নিয়মিত ক্লাস হয় না। ক্লাস পরিক্ষাও হয় না। কতিপয় শিক্ষকদের দ্বায়িত্ব হীনতা ও বখাটেদের উৎপাতে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। কলেজে লেখাপড়ার কোন পরিবেশই নেই।
অভিভাবক লিলু মিয়া সিলেটভিউ’কে বলেন, অব্যবস্থাপনার কারনে ঐতিহ্যবাহী এ কলেজটির এখন বেহাল অবস্থা। বখাটেদের কারনে ছাত্রীরা নিরাপদে ক্লাস করতে পারে না। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। কলেজটিতে অবিলম্ভে সিসি ক্যামেরা ও প্রতিটি ক্লাসে সাউন্ড সিস্টেম স্থাপন করে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত পাঠদান ও যথা সময়ে পরিক্ষা নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে দ্রুত বাউন্ডারি দেওয়াল নির্মান করতে হবে। সেইসাথে ছাত্র-ছাত্রীদের কলেজ ড্রেস চালু করতে হবে। কলেজটিতে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার সুষ্ঠ পরিবেশ নিশ্চিত করতে এলাকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, অভিভাবক, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জরুরী হস্থক্ষেপ প্রয়োজন।
এদিকে- গত মঙ্গলবার কলেজ মিলনায়তনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক সভা করেন জগন্নাথপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) মিজানূর রহমান।
তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য বলেন, প্রত্যেক বাবা-মা সন্তানদের কলেজে পাঠান সুশিক্ষা অর্জন করে ভাল মানুষ হওয়ার জন্য, বখাটেপনা করে মা বাবাকে কলংকিত করার জন্য নয়। কলেজে বখাটেপনা ও ইভটিজিং করলে কঠোর পদক্ষেপ নিব।
তিনি বলেন, এখানে ছাত্রীদেরকে দেখতে হবে নিজেদের বোনের মত। এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পর্ক হবে ভাই-বোনের মত। শিক্ষকদেরকে সম্মন করতে হবে ও তাদের আদেশ মেনে চলতে হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা সাজেদুল ইসলাম সিলেটভিউ’কে বলেন, আমি সরেজমিন পরিদর্শনকালে কলেজে ব্যাপক অনিয়ম দেখেছি। কলেজে নানা অনিয়ম ও সমস্যা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো। খুব দ্রুতই শিক্ষকরা বকেয়া বেতন পাবেন।
কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জাহিদুল ইসলাম সিলেটভিউ’কে বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে কলেজে নানা সমস্যা বিরাজমান। চক ডাস্টার পর্যন্ত নেই। কলেজে ফান্ড থাকলেও আমরা তুলতে পারছি না। ৮ মাস ধরে শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন না। কলেজটি জাতীয়করণ করা হলেও এর সুফল এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। আর বখাটেদের চিহ্নিত করে আমরা প্রশাসনকে জানাব। আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ে অচিরেই সভা করে কলেজের শিক্ষার সষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো।
উল্লেখ্য, সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে তৎকালীন জাতীয় পার্টি সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমপি মরহুম হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর উদ্যোগে ১৯৮৭ সালে জগন্নাথপুর উপজেলা সদরে জগন্নাথপুর কলেজ স্থাপন করা হয়। ২০১৮ সালে আগস্ট মাসে বর্তমান সরকার কলেজটি জাতীয়করণ করে। তবে এখনও কোন সুফল মেলেনি।